শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ , ১৯ রমজান ১৪৪৫

ফিচার
  >
ইতিহাস ও ঐতিহ্য

অর্ধবঙ্গেশ্বরী রাণী ভবানীর রাজবাড়ি

নিউজজি প্রতিবেদক ২ নভেম্বর , ২০১৭, ১৮:৪৭:২৬

24K
  • ইন্টারনেট

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সংস্কৃতি সমৃদ্ধ দেশ বাংলাদেশ। এই দেশে রয়েছে মূল্যবান বহু ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক ও স্থাপত্যের নিদর্শন। আর বাংলাদেশের এই নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে নাটোর রাজবাড়ি।

অর্ধবঙ্গেশ্বরী রাণী ভবানী খ্যাত নাটোর অতীত গৌরব আর ঐতিহ্য ধরে দাঁড়িয়ে আছে আজো। সেইসঙ্গে অমর হয়ে রয়েছে নাটোর রাজবাড়ির রাজাদের অনন্য কীর্তি নারদ নদীর তীরে অবস্থিত রাজশাহী বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা নাটোর।

চলনবিলের সৌন্দর্যমণ্ডিত সুন্দর, ছোট মফস্বল শহর নাটোর। রয়েছে মন মুগ্ধ করার মতো অনেক কিছুই। চলনবিলের সৌন্দর্যের সঙ্গে এখানে অবস্থিত নাটোর রাজবাড়ি আর দিঘাপতিয়ার উত্তরা গণভবন ইতিহাসের স্মারক হিসেবে নাটোরকে করেছে আরো সমৃদ্ধ।

আমাদের দেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের মধ্যে শত শত বছরের পুরোনো রাজবাড়িগুলো অন্যতম। এই রাজবাড়িগুলোর ঐশ্বর্য আমাদের বুঝিয়ে দেয় কতটা সমৃদ্ধ ছিল বাংলা, কত রাজার পা পড়েছে এই বাংলায়। এক কথায় এসব হচ্ছে ইতিহাসের জীবন্ত প্রমাণ। তেমনি একটি রাজবাড়ি হচ্ছে নাটোর রাজবাড়ি।

মহারানী ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত এই রাজবাড়ি। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকাজুড়ে যে কটি রাজবাড়ি তাদের স্থাপত্য-শৈলী ও ইতিহাস দিয়ে পর্যটকদের আকৃষ্ট করে আসছে তার মধ্যে নাটোরের রাজবাড়ি অন্যতম।

রাজা রামজীবন নাটোর রাজবাড়ির প্রথম রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন ১৭০৬ মতান্তরে ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন এবং সে বছরেই মৃত্যুবরণ করেন। সম্ভবত ১৭০৬ -১৭১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ৪৯.১৯২৫ একর জমির ওপর নাটোর রাজবাড়ি নির্মিত হয়েছে। রাজা রামজীবনের মৃত্যুর পর রাজা রামকান্ত ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে নাটোরের রাজা হন। অনেকের মতে, ১৭৩০ থেকে ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজা রামজীবনের দেওয়ান দয়ারাম নাটোরের তত্ত্বাবধান করতেন। রাজা রামকান্ত ১৭৩৪-১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাটোরের রাজত্ব করেন।

পণ্ডিতবর্গ সেই স্থানেই রাজধানী নির্মাণের পরামর্শ দেন। রাজা এই স্থানে রাজবাড়ি নির্মাণ করবেন বলে স্থির করেন। রাজবাড়ি নির্মাণ করার পর রাজ-আমলা, কর্মচারী বহুবিধ লোকের সমাগমে অল্পদিনের মধ্যে বিলটি একটি শহরে পরিণত হয়। সেই পরিণত শহরই নাটোর, সেই রাজবাড়িটিই নাটোর রাজবাড়ি।

১৭৪৮ সালে রাজা রামকান্তের মৃত্যুর পরে নবাব ‘আলীবর্দি খাঁ’ রাজা রামকান্তের স্ত্রী রাণী ভবানীর ওপর জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। রামজীবনের দত্তক পুত্র রাজা রামকান্তের স্ত্রী রাণী ভবানী বিভিন্ন জনহিতকর কাজের মধ্য দিয়ে এ রাজবংশকে ইতিহাসে স্থান করে দেন।

১৭৮৬ সাল পর্যন্ত নাটোর রাজ্য ছিল ভারতবর্ষের মধ্যে বৃহত্তম জমিদারি। রাণী ভবানীর রাজত্বকালে তার জমিদারি বর্তমান রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

ওই সময় রাণী ভবানীর রাজ্য ভ্রমণ করতে প্রায় ৩৫ দিন সময় লাগতো। আর তখন বার্ষিক রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় দেড় কোটি টাকা। মহারাণী রাণী ভবানীর দত্তক পুত্র রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর বিশাল এ জমিদারি তার দুই পুত্র বিশ্বনাথ ও শিবনাথ রায়ের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে বড় তরফ ও ছোট তরফ নামে দুটি আলাদা জমিদারির উত্থান ঘটে।

অপরূপ কারুকার্যখচিত বিশাল এই রাজবাড়ির মোট আয়তন ১২০ একর। রাজবাড়ির চত্বরে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি ভবন রয়েছে। বাইরের শত্রুর হামলা থেকে রক্ষাকল্পে রাজবাড়ির চতুর্দিকে রয়েছে চৌকি বা পরিখা।

একতলা বিশিষ্ট মূল রাজপ্রাসাদে কক্ষ রয়েছে ১৫টি। এছাড়া এখানে দুইটি গভীর পুকুর ও পাঁচটি ছোট পুকুর আছে। রাজবাড়ি বেষ্টন করে আছে দুই স্তরের বেড় চৌকি। পুরো এলাকা বিভক্ত করা রয়েছে দুইটি অংশে। যথা, ছোট তরফ ও বড় তরফ।

রাজবাড়ির উল্লেখযোগ্য মন্দিরগুলো হলো- শ্যামসুন্দর মন্দির, আনন্দময়ী কালীবাড়ি মন্দির, তারকেশ্বর শিব মন্দির।

১৯৮৬ সাল থেকে রাজবাড়ির পুরো এলাকাটি রাণী ভবানী কেন্দ্রীয় উদ্যান বা যুব পার্ক হিসেবে নাটোর জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই রাজভবনে রাজা রামজীবন, রামকান্ত ও অর্ধ-বঙ্গেশ্বরী রাণী ভবানী প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাতেন।

১৯৪৭ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলে শেষ রাজা প্রতিভানাথ ১৯৫২ সালে সপরিবারে কলিকাতায় বসবাস করতে থাকেন। ১৯৬৬ সালে তত্কালিন পাকিস্তান সরকার ভবনটিকে গভর্নর হাউজ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৭ সালের ২৪ জুলাই তত্কালিন গভর্ণর মোনায়েম খান আনুষ্ঠানিকভাবে গভর্ণর হাউজের উদ্বোধন করেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিঘাপতিয়া রাজবাড়িকে উত্তরা গণভবন হিসাবে ঘোষণা করেন। এরপর ভবনটি সংস্কার করা হয় । বর্তমানে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের মিটিং এখানে অনুষ্ঠিত হয়।

নাটোর রাজবাড়ি বর্তমানে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। ১০ টাকা টিকিটের বিনিময়ে সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সাধারণ দর্শনার্থীরা রাজবাড়িতে প্রবেশ করতে পারেন।

যা দেখবেন:

নাটোর রাজবাড়ি যাওয়ার জন্য আপনাকে নাটোর শহর থেকে মাদ্রাসা রোড পেরিয়ে বগুড়া রোড ধরে এগোতে হবে। পথে যেতে আপনার নজরে পড়বে ১৮৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত নাটোর মহারাজা জে এন উচ্চ বিদ্যালয়টি। এসব দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন নাটোর রাজবাড়িতে। রাজবাড়িটি বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন রয়েছে। এখানে দেখার মতো রয়েছে অনেক কিছুই। রাজবাড়ির প্রবেশমুখেই বিশাল একটি শানবাঁধানো পুকুর।

রাজবাড়ি ঘিরে আছে বিশাল বিশাল সব গাছ। এখানে জনসমাগম নজরে রেখে নির্মাণ করা হচ্ছে কমিউনিটি সেন্টার। কমিউনিটি সেন্টার থেকে আরেকটু এগোলেই তারকেশ্বর মন্দির, তার একটু সামনেই ডান পাশে দেখতে পাবেন বিশাল একটি মাঠ। এই মাঠের প্রান্তরে দাঁড়ালেই আপনার নজর কাড়বে রাজবাড়ির একতলা ভবনটি। একতলা এই ভবনটির নাম ছোট তরফ। ছোট তরফ মূলত বিশাল রাজবাড়ির একটি ছোট অংশ। ছোট তরফের ঠিক উল্টো পাশেই বড় তরফ। এই তরফ দুটির পাশে রয়েছে বিশাল পরিখা। পুরো রাজবাড়িতে রয়েছে মোট পাঁচটি পুকুর।

রাজবাড়ির আঙিনায় রয়েছে বিশাল বিশাল আটটি শিবমন্দির। মন্দিরগুলোতে এখনো রীতি মেনে নিয়মিত পূজা-অর্চনা করা হয়। দৃষ্টিনন্দন এই মন্দিরগুলো আপনাকে মুগ্ধ করবেই। মন্দিরের দেয়ালজুড়ে রয়েছে প্রাচীন টেরাকোটার শিল্পকর্ম। মন্দিরকে ঘিরে আছে একটি শিবমূর্তি, ফণা তোলা সাপের মূর্তি, একজন বাউলের মূর্তিসহ নানা রকমের শৈল্পিক কারুকাজ। ওপরে ওঠার জন্য প্রতিটি ভবনের পাশেই রয়েছে লোহার তৈরি ঘোরানো সিঁড়ি। ঘুরতে ঘুরতে দেখা মিলে যাবে রানি মহলের। এই মহলটিতেই বাস করতেন রানি ভবানী। নাটোরে এলে বিখ্যাত মিষ্টি কাঁচাগোল্লা খেতে ভুলবেন না যেন।

নিউজজি/ এসআই

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন