শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ , ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

দেশ

উদ্বোধনের অপেক্ষায় স্বপ্নের পদ্মা সেতু

নিউজজি ডেস্ক ২৩ জুন, ২০২২, ১১:৫৮:২০

6K
  • ছবি : ফাইল

ঢাকা ‍: দেশবাসীর স্বপ্নের সেতুতে চড়ে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চলেছে। আর মাত্র একদিন পরই উদ্বোধন হচ্ছে দেশের ইতিহাসের অন্যতম মেগা প্রজেক্ট পদ্মা সেতু। আগামী ২৫ জুন (শনিবার) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বপ্নের এই পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন। যার মধ্য দিয়ে লাঘব হতে চলেছে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের আজন্ম কষ্ট। ঢাকার সঙ্গে পুরো দক্ষিণবঙ্গের সরাসরি এই যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরো অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিপ্লব সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

উদ্বোধনের পরদিন ২৬শে জুন ভোরে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে বহুল প্রত্যাশিত এই সেতু। এতে ১৩ ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারবে। তবে নসিমন, করিমন, ভটভটি ও সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করতে পারবে না। এমনকি হেঁটেও মানুষ যাতায়াত করতে পারবে না। এরই মধ্যে পদ্মা সেতুতে গাড়ি পারাপারে টোল নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে কোন ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারবে তাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।

এরই মধ্যে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করেছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (এমবিইসি)। ঠিকাদার তার কাজ শেষ করে সেতু বুঝিয়ে দিয়েছে। তবে যে কোনো অবকাঠামোর ক্ষেত্রে ছোটখাটো কাজ থাকবে। আগামী একবছর ধরে তারা সে কাজ ‘ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড’ করবে।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান ঘিরে দেশজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের এই উৎসবকে কেন্দ্র করে যেন কোন ধরনের নাশকতা বা অপতৎপরতা চালাতে না পারে সেজন্য বাড়তি সতর্কাবস্থায় রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, বিশিষ্ট রাজনীতিক ছাড়াও বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। তাদের নিরাপত্তায় নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। উদ্বোধনের দিন পদ্মার দুই পাড়েই র‌্যাব-পুলিশসহ অন্তত পাঁচ হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ইউনিফর্মে মোতায়েন থাকবেন। এর বাইরে সাদা পোশাকে বিপুল সংখ্যক সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ইউনিটের গোয়েন্দা সদস্যরা সেতুকে ঘিরে দুই পাড়েই তৎপর রয়েছেন।

সেতুর দুই প্রান্ত, সমাবেশস্থলসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে র‌্যাবের বোম্ব ডিস্পোজাল ইউনিট ও ডগ স্কোয়াডসুইপিং করবে। যে কোন উদ্ভুত পরিস্থিতির জন্য সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত থাকবে র‌্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডো টিম। পাশাপাশি, যেকোন পরিস্থিতিতে র্যাব এয়ার উইংয়ের হেলিকপ্টার সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছে।

সেতুর মোট খরচ ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার পুরোটাই অর্থ বিভাগ থেকে ঋণ নিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ। এই টাকা ৩৬ বছরে শোধ করতে হবে।

প্রকল্পের নাম: পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প।

প্রকল্পের অবস্থান: রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। দেশের মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলায় প্রকল্পের অবস্থান। সেতুর উত্তর প্রান্তে মাওয়া, লৌহজং, মুন্সিগঞ্জ এবং দক্ষিণ প্রান্তে জাজিরা, শরীয়তপুর, শিবচর ও মাদারীপুর।

যেভাবে শুরু: ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়। এরপর ২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই হয়। ২০০৪ সালের জুলাই মাসে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সুপারিশ মেনে মাওয়া-জাজিরার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করে। মহাজোট সরকার শপথ নিয়েই তাদের নিয়োগ দেয়। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু করার চূড়ান্ত নকশা করা হয়।

একনেক সভায় অনুমোদন: ২০০৭ সালে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন পায়। পরে নকশা পরিবর্তন হয়ে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয়ও বাড়ে। ২০১১ সালে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার সংশোধিত প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালে আবারও আট হাজার ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ালে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সবশেষ প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর পুরো টাকাই সরকারি অর্থায়ন।

প্রকল্পের মেয়াদ: ১ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ৩০ জুন ২০২৩।

পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়া: পদ্মা সেতু নির্মাণে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ অঙ্গীকার করেছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু অনিয়মের অভিযোগ তুলে এই অঙ্গীকার থেকে সংস্থাটি সরে যায়। এ ধরনের কাজের শর্ত অনুযায়ী মূল ঋণদাতা চলে গেলে চলে যায় অন্যরাও। কাজেই একে একে এডিবি, জাইকা ও আইডিবিও চলে যায়। এরপর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রকল্পের মোট ব্যয়: ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।

মূল সেতুর ঠিকাদার: পদ্মা সেতু নির্মাণে চুক্তিবদ্ধ কোম্পানির নাম চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের আওতাধীন চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি।

মূল চুক্তিমূল্য: ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা।

কাজ শুরু: ২৬ নভেম্বর, ২০১৪।

চুক্তি অনুযায়ী কাজ সমাপ্তির তারিখ: ২৫ নভেম্বর, ২০১৮। পরে কয়েক ধাপে সময় বাড়ানো হয়।

কাজের মূল সময়সীমা: ৪৮ মাস। বর্ধিত সময় ৪৩ মাস।

কাজ সমাপ্তির পুনঃনির্ধারিত তারিখ: ৩০ জুন, ২০২২ (বর্ধিত সময়সহ)।

এ পর্যন্ত কাজের ভৌত/বাস্তব অগ্রগতি: ৯৮ শতাংশ।

রেল সংযোগ: পদ্মা সেতুতে রেললাইন স্থাপন হচ্ছে স্প্যানের মধ্য দিয়ে।

অফিসিয়াল নাম: পদ্মা সেতু।

নকশা: আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইসিওএমের (AECOM) নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল।

ধরন: পদ্মা সেতুর ধরন দ্বিতলবিশিষ্ট।

প্রধান উপকরণ: কংক্রিট ও স্টিল।

রক্ষণাবেক্ষণ: বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ।

দৈর্ঘ্য: পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার।

প্রস্থ: পদ্মা সেতুর প্রস্থ হবে ৭২ ফুট, এতে থাকবে চার লেনের সড়ক। মাঝখানে রোড ডিভাইডার।

ভায়াডাক্ট: পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ১৮ কিলোমিটার।

ভায়াডাক্ট পিলার: ৮১টি।

পানির স্তর থেকে উচ্চতা: ৬০ ফুট।

পাইলিং গভীরতা: ৩৮৩ ফুট।

মোট পিলার: ৪২টি।

মোট পাইলিং: ২৮৬টি।

সংযোগ সড়ক: পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক দুই প্রান্তে (জাজিরা ও মাওয়া) ১৪ কিলোমিটার।

মোট লোকবল: পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করছে প্রায় চার হাজার মানুষ।

প্রবৃদ্ধি বাড়বে: ১ দশমিক ২ শতাংশ।

নদীশাসন: প্রকল্প এলাকায় প্রায় ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন করতে হচ্ছে। এর মধ্যে মাওয়া এলাকায় ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার এবং বাকি ১২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার জাজিরা এলাকায়।

ঠিকাদারের নাম: সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড চায়না।

চুক্তিমূল্য: ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা।

ভূমি অধিগ্রহণ: ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ ২ হাজার ৬৯৩ দশমিক ২১ হেক্টর।

অ্যাপ্রোচ রোড: জাজিরা ও মাওয়া।

সেতু পাড়ে বৃক্ষরোপণ: লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৪ লক্ষাধিক।

পদ্মা সেতু জাদুঘর স্থাপন

পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় ‘পদ্মা সেতু জাদুঘর প্রতিষ্ঠা’র জন্য নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ চলমান।

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও অভয়ারণ্য ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি: পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা সম্পন্ন হয়েছে এবং গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। ‘খসড়া ম্যানেজমেন্ট প্লান’ চূড়ান্তকরণের কাজ চলমান।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন