মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ , ২২ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

আহা, কী মধুর প্রতিশোধ!

বোরহান বিশ্বাস ৬ মে , ২০২৩, ১২:২৭:৪৯

596
  • আহা, কী মধুর প্রতিশোধ!

১৫ দিনের তিন দেশ সফরে (জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। তাঁর এই দীর্ঘ সফরের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক।

সফরকালে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ওয়াশিংটনের হোটেল দ্য রিটজ কার্লটনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এসময় আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাংলাদেশকে বিশ্বে একটি রোল মডেল বলে উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে দেশটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন অর্জন করেছে। এমনকি করোনা মহামারীর পরও অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে পেরেছে।’ তাঁর যে বক্তব্যটি গণমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে সেটি হলো- ‘সব প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মতো নেতৃত্ব জরুরি।’ 

পরে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারত্বের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিশ্বব্যাংককে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সুযোগ এবং গ্রহণ করার ক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশ কখনো ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়নি বা তথাকথিত ‘ঋণের ফাঁদে’ পড়েনি। বিশ্বব্যাংকের বোর্ড অব এক্সিকিউটিভ ডিরেকটর্সদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

‘বাইরের চাপে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তে হতাশ হয়েছিলাম’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিশ্বব্যাংককে অবশ্যই তার মূল উদ্দেশ্য দারিদ্র বিমোচন এবং উন্নয়ন অর্থায়নের প্রতি মনোযোগী থাকতে হবে। আমরা এখন আমাদের অংশীদারিত্বের ভবিষ্যতের দিকে দেখতে চাই।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নিজস্ব অর্থায়ন ও প্রযুক্তি সম্পদ দিয়ে ছয় দশমিক এক কিলোমিটার পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার লক্ষণ।’ এই অনুষ্ঠানেই বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাসকে পদ্মা সেতুর একটি বাঁধাই করা ছবি উপহার দেন প্রধানমন্ত্রী। 

এ যেন মধুর প্রতিশোধ! যারা সাত-পাঁচ না ভেবে অন্যের প্ররোচণায় বাঙালির আবেগ পদ্মা সেতু থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছিল সেই সংস্থার প্রধানের হাতেই প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর ছবি তুলে দিয়েছেন! এটা বাঙালির জন্য অনেক বড় অর্জন, গৌরবের বিষয়। 

তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ যথার্থই বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে যে ভুল করেছিলো সেটি উপলব্ধি করে এখন বাংলাদেশকে সর্বোতভাবে সহায়তা করতে চায়।’ ওয়াশিংটনে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ২২৫ কোটি ডলারের প্রকল্প ঋণচুক্তি স্বাক্ষর বিষয়ে তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক তাদের ভুল অনুধাবন করতে পারার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়ে ওয়াশিংটনে নিয়ে গেছে।

আমরা তাদের সব ধরণের সহায়তা নেবো তা কিন্তু নয়। বিশ্বব্যাংক পরবর্তীতে পদ্মা সেতুতেও সহায়তা করতে চেয়েছিলো, আমরা সেটি নেইনি। আরো বেশ কয়েকটি প্রকল্পেও ইতিপূর্বে সহায়তা করতে চেয়েছে। কোন সহায়তা নেবো আর কোনটা নেবো না- সেটা ঠিক করার সামর্থ্য এবং সাহস শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্জন করেছে।’

অথচ বাঙালীর এত আশা যে পদ্মা সেতুকে ঘিরে, তাকে নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। কাজটি তখন কাদা-মাটির মিশ্রণে সবেমাত্র তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু অবয়ব পাওয়ার ঠিক আগে এদেশেরই একজন নোভেলিস্ট এবং দুটি তথাকথিত পত্রিকার মিথ্যা প্রচার-প্রচারণায় বিশ্বব্যাংক সেতুর জন্য তাদের নির্ধারিত ১২০ কোটি ডলারের অঙ্গীকার থেকে সরে যায়। এ ধরনের কাজের শর্ত অনুযায়ী মূল ঋণদাতা চলে গেলে অন্যরাও চলে যায়।

সেই ধারাতেই একে একে এডিবি, জাইকা ও আইডিবিও চলে যায়। আশা-নিরাশার দোলাচলের সেই সন্ধিক্ষণে প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিলেন, নিজেদের অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। সে কি অভূতপূর্ব সাড়া! কোমলমতি শিশুরা পর্যন্ত তাদের টিফিনের টাকা সেতু নির্মাণের জন্য জমাতে শুরু করে দিল।

পদ্মা সেতু থেকে বিশ্ব ব্যাংকের সরে যাওয়ার আঘাতটি পুরো বাঙালী জাতির আত্মসম্মানে লাগে। বিধায় নিজ অর্থেই স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যায় দেশ। সেই স্বপ্নটি প্রধানমন্ত্রী বাঙালী জাতিকে দেখাতে পেরেছিলেন। তবে, যে অভিযোগের ভিত্তিতে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিতর্ক উঠেছিল, পরে ভিত্তিহীন প্রমাণিত হওয়ায় কানাডার আদালত তা খারিজ করে দেয়।

অভিযোগ ছিল- কানাডিয়ান কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ পাওয়ার চেষ্টায় বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে তাদের ঋণ বন্ধ করে দেয়। ওই দুর্নীতির অভিযোগে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন এবং ওই সময়ের সেতু বিভাগের সচিবকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

সর্বশেষ বিষয়টি মিথ্যা প্রমাণিত হলেও যাদের কারণে ওই অবস্থারন সৃষ্টি, তারা কিন্তু এখনো বহাল তবিয়তে আছে। ন্যায় বিচার এবং স্বচ্ছতার স্বার্থে তাদের আইনের আওতায় এনে দেশ ও দেশের মানুষের সামনে চক্রান্তকারিদের মুখোশ খুলে দিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পদক্ষেপ নেবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা।

যা হোক, প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ১ মে বিবিসি বাংলা ‘সহজ ঋণের জন্য বাংলাদেশে যেভাবে অপরিহার্য হয়ে উঠলো বিশ্বব্যাংক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়- ‘‘বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশের সাথে তাদের ৫০ বছরের সম্পর্ক উদযাপন করছে বেশ আয়োজন করে। এই উদযাপনে অংশ নিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন।

বিশ্ব ব্যাংকের যে শাখা- ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ) নিম্ন আয়ের দেশগুলোর উন্নয়নের জন্য ঋণ দেয়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী দেশ বাংলাদেশ। অন্যদিকে বাংলাদেশেরও সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক।

বিশ্ব ব্যাংকের হিসেবে, সত্তরের দশকের শুরুতে উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের সক্ষমতা সম্পর্কে ব্যাংক যতটুকু ধারণা করেছিল সেটিকে বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। গত ৫০ বছরে আইডিএ’র কাছ থেকে অনুদান, সুদমুক্ত ঋণ আর কম সুদে প্রায় ৩ হাজার ৯০০ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে আইডিএ’র সহায়তায় প্রায় ১৬০০ কোটি ডলারের ৫৫টি প্রকল্প চলমান রয়েছে বাংলাদেশে।’’

প্রতিবেদনটিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে- ‘‘অর্থনীতিবিদদের মতে, গত ৫০ বছরে একবারই বিশ্বব্যাংকের সাথে বাংলাদেশের ‘শীতল সম্পর্ক’ তৈরি হয়েছিল। সেটি হলো ২০১২ সালে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে। সেসময় বিশ্ব ব্যাংকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প (১২০ কোটি ডলার) ছিল পদ্মা সেতু প্রকল্প। সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় এবং সেই তদন্তে বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা না করায় এই পদক্ষেপ নিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। তবে পরে এসব অভিযোগের কোনোটিই প্রমাণিত হয়নি।

পদ্মা সেতু থেকে সরে আসার পরে বিশ্ব ব্যাংক তাদের কান্ট্রি অ্যাসিস্ট্যান্ট স্ট্র্যাটেজি রিভিউ করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে বাংলাদেশে ভৌত অবকাঠামোগত হাই রিস্ক প্রকল্পে তারা ভেবেচিন্তে ঋণ দেবে। কিন্তু পরে বিশ্বব্যাংকের ভেতর থেকেই একটা আপত্তি আসে যে, বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে ভৌত অবকাঠামো তৈরিতে সহায়তা না করলে উন্নয়নে অবদান কীভাবে রাখা যাবে!’’

‘তবে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে আসার পর বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে বিশ্ব ব্যাংকের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে’ বলে ওই প্রতিবেদনে মন্তব্য দেন বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন।

অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, ‘বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থা নিজেদের স্বার্থেই বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রমের পরিধি বাড়িয়েছে। আমরা লক্ষ্য করেছি, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে আসার পর তারা আরো নমনীয় হয়েছে।’

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বরাবরের মতো এবারও যথারীতি বলেছেন, ‘আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের ফলাফল শূন্য।’ এতো অর্জনের পরও কোন অর্থে তিনি শূন্য বোঝাচ্ছেন তা বোধগম্য নয়। মনে হচ্ছে বিরোধীতার জন্যই তিনি বিপক্ষে কথা বলছেন। 

কথায় আছে- ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’। পদ্মা সেতু নিয়ে দেশি-বিদেশী যে চক্রান্ত শুরু হয়েছিল তা অবশেষে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বব্যাংককে অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। সবকিছু অনুধাবন করেই বিশ্বব্যাংক যে বাংলাদেশের সঙ্গে আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় গাঁটছড়া বেঁধেছে এটা এখন নিঃসন্দেহেই বলা যায়।

লেখক : সাংবাদিক।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন