বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১ , ২৬ রমজান ১৪৪৬

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

প্রেস ও মিডিয়ায় পুরুষ আধিপত্যে নিরপেক্ষতা প্রশ্ন সাপেক্ষ!

কাজী সুলতানা শিমি ৫ আগস্ট , ২০২৩, ১৩:৩৬:৩৪

641
  • প্রেস ও মিডিয়ায় পুরুষ আধিপত্যে নিরপেক্ষতা প্রশ্ন সাপেক্ষ!

আজকাল সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুক, টুইটার, বা ইন্সট্রাগ্রামের সুবাদে চারপাশে বা সমাজে কী ঘটছে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায়। স্বশরীরে সব জায়গায় না গেলেও চলে। অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার মিডিয়াতে নিয়মিত খেয়াল রাখতে গিয়ে একটা ব্যাপার খুব চোখে পরে। সেটা হচ্ছে মিডিয়া, প্রেস কনফারেন্স, রিপোর্টিং-এ মেয়েদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। আর শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে মিডিয়া ও প্রেসের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী, অন্ধসহ পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী তথা আদিবাসীদেরও উৎসাহী করা হচ্ছে নানা সুবিধা দিয়ে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা হচ্ছে বিপরীতমুখী। সম্প্রতি সিডনিতে একটি সিনেমার প্রেস কনফারেন্স দিয়েই প্রসঙ্গটা শুরু করি। তো সেই প্রেস কনফারেন্সে দেখা গেল কনফারেন্সে যিনি কথা বলছেন তিনি একজন পুরুষ, যারা সেখানে উপস্থিত হয়েছেন তাদের অধিকাংশই পুরুষ এবং জানা গেছে যারা এই কনফারেন্সটির আয়োজক তারাও পুরুষ।

সমাজে নারী পুরুষের সমতা আনার যে কথা বলা বলি বা লেখালেখি হয় প্রবাসী বাংলাদেশি মিডিয়ার ক্ষেত্রে নারী বা মেয়েদের উপস্থিতিটাকে বিবেচনায় নেয়া হয় না মোটেও। বাংলাদেশি সমাজ অধিপতি বা নীতিনীর্ধরক যেহেতু এখনো বেশির ভাগ পুরুষ সেজন্য সেটাকে তারা নিজেদের জায়গা বলেই এখনো মনে করে আসছেন। তারা মনে করে মেয়েরা বড় জোর নাচ, গান বা কবিতা আবৃত্তি করলেই তাদের সামাজিক- সাংস্কৃতিক দায়িত্ব পালন করা শেষ।

কিছু দিন আগে এক আড্ডার একটি প্রসঙ্গ ছিল, মেয়েদের রূপ বর্ণনা নিয়ে এত শত কাব্যকথা, গল্প-কবিতা, নাটক-উপাখ্যান লেখা হয় সে তুলনায় পুরুষদের নিয়ে লেখা হয় না কেন! উত্তরে একজন ভদ্রলোক বলেছিলেন প্রাণীদের মধ্যে পুরুষ প্রজাতি নাকি এম্নিতেই সুন্দর তাই তাদের রূপের বন্দনা করার দরকার হয় না। উদাহরণ হিসেবে তিনি ময়ূর, সিংহ, এবং আরও কিছু প্রাণীর প্রসঙ্গ টেনে ছিলেন।

তখন অন্য আরেক জন যোগ করলেন ছেলেদের দেখার চোখ সুন্দর তাই তারা রূপবর্ণনা করতে কার্পণ্য করে না। একটু খেয়াল করলেই পরিষ্কার হবে যে, সবক্ষেত্রেই আসলে পুরুষ আধিপত্য। সভ্যতার শুরু থেকেই তা হয়ে আসছে। অন্য সব প্রাণীদের মধ্যে পুরুষ প্রজাতি সুন্দর হলেও মানুষের ক্ষেত্রে সেটা সত্য নয়। স্বভাবগতভাবে পুরুষ প্রজাতি নির্মম ও খানিকটা বর্বরোচিতও বটে। তারা শুধু মাত্র নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার স্বার্থে মেয়েদের টিকিয়ে রেখেছে। পৃথিবীর অনেক দেশে এখনো মেয়েদের প্রতি বর্বরোচিত আচরণ করা হচ্ছে। পৃথিবীতে বেশির ভাগ অপরাধ এখনো পুরুষদের দ্বারাই সংগঠিত হয়। আর মেয়েদের অন্যদের নিয়ে রূপ বন্দনা করার সময়ই বা কোথায়!

ঘরে বাইরে কাজ করার পর নিজেদের জন্যইতো তারা সময় বের করতে পারে না। পুরুষদের আছে অঢেল সময় আর সে সময় দিয়েই তারা কাব্যরচনায় বা রূপবন্দনায় নিবৃত হয়। কারও রূপবন্দনা দুরে থাক মেয়েরা নিজেদের মত বা ভাবনা চিন্তাগুলো প্রকাশ করারই বা সমর্থন কতটুকু পায়! পশ্চিমা দেশগুলোতে যারা অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে তাদের সমতালে কাজ করার জন্য নানারকম সুবিধা দেয়া হয়। এই যেমন বর্তমানে আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের জন্য কন্সটিটিউশন পরিবর্তন করার চিন্তা হচ্ছে। এছাড়াও চাকরি বা সেবা দানের ক্ষেত্রেও বাড়তি কোনো সাহায্য লাগবে কি না তার উপর গুরত্ব দেয়া হয় বা ক্ষেত্র বিশেষে নানা সুবিধা ও রাখা হয়। কিন্তু বাংলাদেশিদের বেলায় মেয়েদের সুযোগতো দুরে থাক বরং যারা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে মিডিয়া বা লেখালেখিতে দক্ষতা অর্জন করার চেষ্টা করে তাদের নানা ভাবে দমিয়ে রাখতে তৎপর হয়ে পরে নামধারী সুশীল সমাজ। মেয়েদের সহযাত্রী বা সহযোদ্ধা হিসেবে সহযোগিতার হাত বাড়ানো দূরে থাক প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে বা তাচ্ছিল্য করে দুরে সরানোর নানা প্রয়াস চলে। যেন মিডিয়া বা লেখালেখি তাদের জন্য নয়। আর যদি নেহায়েত লেখালেখি করেও থাকে তারা যেন কেবল গল্প-কবিতা বা আত্মজীবনীতেই তাদের সীমারেখা এঁকে দেয়। জীবনদর্শন বা সমাজ, রাজনীতি, প্রেস-মিডিয়া তাদের জন্য নয়! অথচ সমাজে নারী পুরুষের অবদান সমান। শুধু পারিবারিক বা সংসার সামলানোই তাদের একমাত্র কাজ নয়।

প্রবাসে এসেও সমাজসেবামূলক যে কোনো সভা-সমিতি, আলোচনা বা মত-বিনিময়ও মিডিয়া সমাবেশের মঞ্চে পুরুষরাই চেয়ার দখল করে বসে থাকেন। অবস্থাটা এমন যেন মেয়েদের কাজ তো কেবল ঘর সামলানো। এমনকি তারা অফিস বা বাইরের কাজ করে আসার পরও ঘরের আনুষঙ্গিক কাজ তাদের জন্য অবধারিত! সেজন্য পুরুষেরা মনে করে মেয়েরা বাইরের জগত তথা মিডিয়া, রাজনীতি, দর্শন বা বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা মতামত দেয়ার যোগ্যতা রাখে না। এমন কি দর্শন, নীতি বিদ্যার মতো একাডেমিক অর্জন থাকলেও! তারা বড়োজোর কাজ শেষে সংসার সামলাবে, শাড়ি-গয়নায় সেজেকিং বা হিজাবটি কলি পরে পার্টি বা আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ রক্ষা করবে। এটুকুতেই তাদের মানায় কেবল! সবচে’ লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে মেয়েদের এই মেয়েলিপনা বা সংসারে আবদ্ধ করে রাখা নিয়ে প্রচারণা করেন সমাজের সুশীল নামধারীরা। তারা নিজেরা নিজেদের সাংবাদিক, সম্পাদক, নাট্যকার, মিডিয়াব্যক্তিত্ব ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি বোধ করলেও মেয়েদের বা নারীদের শুধুই সংসারী বা মেয়েলি উপমায় বিশেষায়িত করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এই নামধারী সুশীলদের লেখা, পোস্ট কিংবা আলোচনায় মেয়েদের মা-মেয়ে-বোনের তকমা লাগিয়ে রাখেন।

ভাবনা-চিন্তাগুলো অত্যন্ত বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞভাবে প্রকাশ করে থাকেন। আদতে তারা শুধু বলা, বা লেখাতেই মেয়েদের সম্মান করার একটা আবরণ ঝুলিয়ে রাখেন। বাস্তব সম্পূর্ণই ভিন্ন। এইযে মেয়েদের কেবল বই পুস্তক আর বাহ্যিকভাবে সম্মান দেখানোর একটা আবহ চলছে সেটা মিডিয়া বা সভা সমিতিতে মেয়েদের অবস্থান থেকেই অনুমান করা যায়। শুধু মিডিয়ার ক্ষেত্রে নয়, মেয়েরা তাদের অধিকার আদায়ের লড়াই বারবর একাই চালিয়ে এসেছে সব কিছুতেই। আগামীতেও চালিয়ে যাবে একাই। তবুও আশা সুশীল সমাজপতিদের একটু বোধ উদয় হোক। শুধু মা-মেয়ে-বোনের উপমা বাদ দিয়ে তাদের উদারতা আরেকটুখানি প্রসারিত হোক। মেয়েদের সহযোদ্ধা আর সহযাত্রী ভেবে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ রেখে এগুতে পারলে পৃথিবীটা বোধ করি আরেকটু সুন্দর হতো। শুধু কথা আর কাব্যে নয়, মেয়েরাও যে সমাজে সমতালে অবদান রাখার যোগ্যতা রাখে সে ভাবনাটুকু প্রকাশিত হোক সুশীলদের বাস্তব আচরণে, দৈনন্দিন অভ্যাসে। একটি নিরপেক্ষ ও নির্ভরতার সমাজ তৈরি হয় নারীপুরুষের সমান্তরাল প্রয়াসেই! আর পারস্পরিক সমর্থন না থাকলে সব কিছু প্রশ্ন সাপেক্ষই থেকে যাবে।

লেখক: আস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন