সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২ , ১৯ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

জিপিএ-৫ এর ভিড়ে হারিয়ে গেছে মূল্যবোধ!

আব্দুল্যাহ আল নোমান ৯ আগস্ট , ২০২৩, ১৯:০৪:৩৫

3K
  • জিপিএ-৫ এর ভিড়ে হারিয়ে গেছে মূল্যবোধ!

খুব বেশি বছর অতীতের কথা নয়। এই তো গত তিন দশক আগেও একজন শিক্ষার্থী এসএসসি বা সমমান পাশ করলে ১০ গ্রামের মানুষ তাকে দেখতে আসত। আর যদি লেটার মার্কস পেতো, তাহলে তিন গ্রাম জুড়ে আনন্দের বন্যা বইত। লেটার মার্কস মানে শতকরা প্রতি বিষয়ে ৮০ মার্কস। যা বর্তমানে গোল্ডেনএ প্লাস/জিপিএ-৫ হিসেবে ধরা হয়। এই লেটার মার্কস যারা পেতেন তারা যদি সামর্থবান হতেন তাহলে গ্রামজুড়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন। নব্বই দশকের শেষ দিকে জন্ম হওয়ায় এমন সব দৃশ্য কম দেখলেও মুরব্বিদের মুখে এসএসসি পাস নিয়ে নানান খোশ গল্প শুনেছি। 

কিন্তু মাত্র তিন দশক সময়ের ব্যবধানে বদলে গেছে পুরো চিত্রপট। এখন এসএসসি/সমমান পাস করলে আগের মত আর সেই উদ্দীপনা নেই। শিক্ষার হার বাড়ার সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়েগেছে আগের সেই সব আনন্দ কিংবা দেখতে আসার দিন। বদলে গেছে শিক্ষার মূল্যবোধ। এখন পরীক্ষায় পাসটা কেবল নামমাত্র। কিন্তু এই নামমাত্র পাস বা মূল্যয়ন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে পরির্বতন আকাশ-পাতাল। 

২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ পেয়েছে গত (২৮ জুলাই)। পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ।জিপিএ-৫ পেয়ে ছিলেন ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন শিক্ষার্থী। বোর্ড পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন সাধারণ মিষ্টি বেশি বানান দোকানিরা। কয়েকটি গণমাধ্যমে দেখলাম, যে রকম মিষ্টি বিক্রি হবে বলে আশা করছিলেন তারা, তার ১০ শতাংশ বিক্রি হয়নি। যাইহোক আজ আর সেই দিকে যাচ্ছি না। জিপিএ-৫ ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া শিক্ষার মূল্যবোধকে একটু খোঁজার চেষ্টা করবো। প্রিয় পাঠক আশাকরি ধৈর্য্যসহকারে সাথে থাকবেন। 

২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পাওয়ায় মোমো (১৬) নামে নাটোরের লালপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। জিপিএ-৫ না পাওয়ায় একই পথ বেছে নেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার খোঁচাবাড়ি গার্লস স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মিষ্টি রায়ও (১৬)। 

গত কয়েক বছর ফল প্রকাশের সময় গণমাধ্যমগুলো চোখ বুলাইলেই দেখা মেলে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা খবর। এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জিপিএ-৫ না পাওয়া। 

গত কয়েক বছরে মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের দিনে পরীক্ষার্থীদের আত্মহত্যার একটি হিসাব তুলে ধরা যাক-২০২৩ সালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী আশানুরূপ ফল না পেয়ে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছে ৬ শিক্ষার্থী। ২০১৮ সালে ফল প্রকাশের সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ২২ জন কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যার চেষ্টা করে। যাদের মধ্যে ১০ জন মারা যান। ২০২০ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২১ জন কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যার করে যাদের মধ্যে ১৯ জনই ছিল কিশোরী। 

নব্বই দশকে ফলাফলের উচ্ছাস আর যে আনন্দের কথা আমরা শুরুতে বলেছি, ক্রমেই কেন সেটি হারিয়ে যাচ্ছে? কেন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না পেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে? 

এর একটি কারণ তা হলো ‘শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য না জানা’। আমরা কেন পড়ছি, কেন পড়ালেখা করা দরকার সেটি সম্পর্কে একজন শিক্ষার্থীকে জানাতে না পারার কারণে শিক্ষার্থীরা আশানুরূপ ফল না পেয়ে আত্মহত্যার মত জঘন্য পথ বেছে নিচ্ছে। এই ক্ষেত্রে দায়ী আমাদের শিক্ষক, অভিবাবক, শিক্ষা পদ্ধতি। যা আমাদের শেখাতে পারেনি শিক্ষার উদ্দেশ্যই হলো মূল্যবোধ শেখা। পাস কিংবা জিপিএ-৫ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য নয়। 

আমাদের দেশে শিক্ষণ পদ্ধতিতেও রাষ্ট্রের কার্যকর নীতি প্রণয়নে দুর্বলতার কারণে শিক্ষার্থীদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে জ্ঞান ও দক্ষতা, মূল্যবোধ অর্জনের চেয়ে সনদ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ফলে অভিভাবকেরা সন্তানের ভালো ফলাফল নিশ্চিত করতে টাকা ঢালছেন। অপরদিকে শিক্ষকেরাও হাঁটছেন সহজ ও ‘শর্টকাট’ পথে। মুখস্থবিদ্যার ওপর ভর করে শিক্ষাজীবন পার করছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাণিজ্য। 

নোবেল বিজয়ী ইংরেজ সাহিত্যিক উইলিয়াম রাল্ফ ইঞ্জ বলেছেন, “শিক্ষার লক্ষ্য হল জ্ঞান নয়, সত্য নয়, মূল্যবোধ।” 

মিশরের বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের (মুসলিম ব্রাদারহুড) অধিনায়ক এবং অবিসংবাদিত নেতা শহীদ সাইয়েদ কুতুব (র.)বলেছেন,“যে সমাজে মানবীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রাধান্য থাকে সে সমাজই সভ্য সমাজ” 

একজন শিক্ষার্থী তার পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নৈতিকতা, শিষ্টাচার ও মূল্যবোধ শিখে থাকে। কিন্তু আমাদের সমাজ আজ একজন মানুষকে সে শিক্ষা দিতে ব্যর্থ। ব্যর্থ আমাদের জ্ঞাতের বাতিঘর নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো। পড়াশোনা করে আমরা নামমাত্র শিক্ষিত হতে পারলেও শিক্ষা মূল্যবোধটা অর্জন করতে পারছি না। 

বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,  “তাকেই বলি শ্রেষ্ট শিক্ষা, যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না, যা বিশ্ব সত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।” 

আমাদের শিক্ষা বিশ্ব সত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তুলতে পারেনি বলেই আমাদের শিক্ষার্থীরা অকৃতকার্য কিংবা একটু হতাশার সমাধান খোঁজে আত্মহত্যায়। জীবন যুদ্ধে দক্ষ সৈনিকের ন্যায় হতাশা, দুর্দশা গুলোকে মোকাবেলা করার পদ্ধতিটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা শেখাতে পারেনি। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আনন্দদায়ক, ব্যক্তিত্ব তৈরির হাতিয়ার ও মূল্যবোধ তৈরির মাধ্যম হিসেবে নিতে পারিনি বলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আজ এই বেহাল দশা।

ভঙ্গুর এই শিক্ষণ পদ্ধতি ও দক্ষতা এবং মূল্যবোধ বিহীন সনদ অর্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে এখনি বেরিয়ে আসতে না পারলে এটি ভবিষ্যতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য আরও বড় কাল হয়ে দাঁড়াবে। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক, অভিভাবক ও সমাজের নীতি নির্ধারকদের সতেচন হওয়া জরুরি।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন