শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২ , ১৬ মুহররম ১৪৪৭

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

'অন্যায় দেখলেই যে বারুদ জ্বলে উঠবে'

সোহেল রানা ৩ আগস্ট , ২০২৪, ২২:০৫:২৮

1
  • 'অন্যায় দেখলেই যে বারুদ জ্বলে উঠবে'

দেশে চলছে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন। দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে আন্দোলন। ১৮ জুলাই ঢাকার চিত্রটা বদলে যায়। সব কিছু স্থবির হয়ে পড়ে। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে। জারি করা হয়েছে কারফিউ। । সব ছাপিয়ে আন্দোলনই গতিময় হচ্ছে।

এক মুক্তিযোদ্ধা বাবার আকুতি, ‘আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, আমার ছেলে মারা গেল বিজিবির গুলিতে’। নিজের ছেলে রাসেল মিয়ার (৩৬) মৃত্যুতে ক্ষোভ প্রকাশ করে এসব কথা বলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাছেন আলী। তাঁর বাড়ি নরসিংদীর বেলাব উপজেলার দুলালকান্দি গ্রামে। শুক্রবার (১৯ জুলাই) রাজধানীর রামপুরায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন রাসেল। মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও পরিবারের শোক এখনো কাটেনি। বাড়িতে চলছে স্বজনদের আহাজারি। রাসেল মিয়া ছিলেন একজন বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও পরিচালক। রাজধানীর রামপুরা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন স্ত্রীকে নিয়ে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে যারা আন্দোলন করছিলেন, তাঁদের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন আবু সাঈদ। ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। সংঘর্ষ শুরু হলে আন্দোলনকারীদের মধ্যে সবার আগে ছিলেন আবু সাঈদ। তাঁর ঠিক সামনে অবস্থান ছিল পুলিশের। জায়গাটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছেন আবু সাঈদ। পেছনে সড়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট। ছবিতে দেখি, পুলিশের ছোড়া গুলিতে আহত হয়ে বসে পড়ছেন তিনি। আরেক ছবিতে একজন তাঁকে তুলে ওঠানোর চেষ্টা করেন। হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক জানালেন, তিনি মারা গেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, মিছিলের সামনে থাকা আবু সাঈদকে লক্ষ্য করেই গুলি করেছে পুলিশ।

মৃত্যুর আগে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ উনসত্তরের শহীদ রাজশাহী  বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে উদ্দেশ্য করে ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘স্যার, এই দিনে আপনাকে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে।’ 

এর কয়েক ঘণ্টা পরই আবু সাঈদ লাশ হয়ে গেলেন। নামাজে জানাজার সময় তাঁর বড় ভাইয়ের আকুতি সমবেত সবাইকে স্পর্শ করেছে। নয় ভাই-বোনের মধ্যে আবু সাঈদই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পেরেছিলেন। তাঁকে নিয়ে তাঁদের অনেক স্বপ্ন ছিল। মা মনোয়ারা বেগম আহাজারি করে বলেন, ‘মোর বাবাটাক পুলিশ গুলি করিয়া মারল ক্যান, চাকরি চাওয়াটা কি অপরাধ?’

'প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন থাকে, ইচ্ছা থাকে। রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো- সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ করে দেওয়া। গুলি করে আন্দোলনকারীদের হত্যা করে পুরো পরিবারের স্বপ্ন চূর্ণ করে দেওয়া নয়।'

শাহজাহান নিউমার্কেটের বলাকা সিনেমা হলের সামনে ফুটপাতে হকারি করে পাপোশ বিক্রি করতেন। বাবা মহসিন আলী অনেক আগেই মারা গেছেন। চার ভাইয়ের মধ্যে শাজাহান ছিলেন তৃতীয়। ঢাকা মেডিকেলে মর্গের সামনে মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ছেলের দোষ কোথায়? কে মারল, কারা মারল-কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

ঘটনার দিন (১৯ জুলাই) ইমরানের অফিসে যাওয়ার কথা ছিল সকাল ৮টায়। হঠাৎ স্ত্রীর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই অফিসে দায়িত্ব পালনের সময় পরিবর্তন করে নিয়েছিলেন সন্ধ্যা ৭টায়। অফিস যাওয়ার আগে বাইরের পরিস্থিতি দেখতে ও স্ত্রীর ওষুধ কিনতে যান ইমরান খলিফা (৩৩)। ফিরতে পারেননি ঘরে। হাসপাতাল থেকে খবর আসে, গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন ইমরান।

তিনি গুলশান-২-এর চারুলতা নামের একটি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর বাড়ি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার নলচিড়া ইউনিয়নের কালনা গ্রামে।

কাঁদতে কাঁদতে তার স্ত্রী শান্তা আক্তার বলেন, মোর কপালে সুখ সইল না, মোরে নিয়া ঢাকায় আইয়া কত কষ্ট করছে, যহন একটা চাকরি পাইল, হেই সময় আল্লাহ অরে নিয়া গেল। মুই এ্যাহন কি নিয়া বাঁচমু, কে মোর ছোট সন্তানকে মানুষ করবে। মুই ওর অফিসের যাওয়ার রাইতের খাবার রেডি কইররা বইয়া আছি, কই, ও তো আহে না।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষের সময় মহাখালীতে গুলিবিদ্ধ হয় ১১ বছরের মিজান। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি।

২০ জুলাই রাজধানীর কাফরুলে বুকে গুলিবিদ্ধ হন শিক্ষার্থী জোহানুল ইসলাম (১৮)। চিকিৎসকেরা তাঁকে জানিয়েছেন, গুলিতে বুকের হাড় ফেটে গেছে। জোহানুল বলেন, গৃহকর্মী না আসায় তাঁর বাসায় রান্না হয়নি। ওইদিন বেলা দেড়টার দিকে খেতে বের হয়েছিলেন। কিন্তু গলির মধ্যে খাবারের দোকান বন্ধ ছিল। তাই আরেকটু সামনে গিয়ে খেয়ে বাসার দিকে ফিরছিলেন।

তিনি বলেন, তখন বেলা ১টা ৫০ মিনিট। মেট্রোরেলের পথ, ছাদ কিংবা ওপর থেকে আসা গুলি বুকে লাগে। পথচারীরা তাঁকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নেওয়া হয়।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করিম বলেন, বাসা থেকে বেরিয়ে হঠাৎ করে তিনি বাঁ হাতের বাহু ও বুকে গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়ার খাজুরিয়া গ্রামে।

ওই দিন বিকেল পাঁচটার পর দিকে রামপুরায় বুকে গুলিবিদ্ধ হন একটি বায়িং হাউস প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী সোহান শাহ (২৮)।

সোহান বলেন, আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? আমি তো রাজনীতি করি না। কবে সুস্থ হবো, কীভাবে সংসার চলবে?

আচ্ছা, একটা জাতির সঙ্গে করা বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কি অনেক বেশি অন্যায় ছিল? এমন ভাবে গুলি করতে হলো, যে গুলি  তীর্যকভাবে পিঠে লেগে মেরুদণ্ড, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, শ্বাসনালী ভেদ করে বুক চিড়ে বের হলো! এ দায় কার?

'শোন বন্ধুরা, তোমরা আমাদের হৃদয়ে আজীবন লালিত স্বপ্নবাজ হিশেবেই বেঁচে থাকবা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তোমাদের বীরত্বের গান গেয়েই যাবে। এই প্রজন্মের প্রতিটা তরুণের বুকে বারুদের জন্ম দিয়ে গিছো, অন্যায় দেখলেই যে বারুদ জ্বলে উঠবে।'

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী।

বি.দ্র.- (এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। নিউজজি২৪ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন