শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ , ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

"করোনা মহামারি প্রতিরোধ ও বিপ্লবী মানবতাবাদ"

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ২৭ এপ্রিল , ২০২০, ০১:৫৭:৩১

6K
  • "করোনা মহামারি প্রতিরোধ ও বিপ্লবী মানবতাবাদ"

‘করোনা ভাইরাস’ সারা বিশ্বে আঘাত হেনেছে। মানবসমাজ তথা ‘মানব অস্তিত্বকে’ চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সে আজ তার বিরুদ্ধে এক মরণযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। প্রতিদিন লাখো মানুষ এই ঘাতক ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্ত মানুষরা হাজারে হাজারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। বিশ্ব ও বিশ্ববাসী আজ ইতিহাসের ভয়াবহতম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পতিত হয়েছে।

এই করোনা ভাইরাসের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সবকিছু এখনো মানুষের জানা সম্ভব হয়নি। ‘ভাইরাসের’ অনেক প্রজাতির মধ্যে সাতটি প্রজাতি মানুষের দেহে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। যে বিশেষ ভাইরাসটি এবার আক্রমণ হেনেছে, তার গতি-প্রকৃতি ও ধরন-ধারণ একেবারেই নতুন। চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া এই 'নভেল করোনার' সংক্রমণকে পরবর্তী সময়ে নামকরণ করা হয়েছে ‘কোভিড-১৯’ (COVID-19)। মানুষের কাছে অপরিচিত ও অদৃশ্য এই ভয়াল হানাদার ঘাতকের বিরুদ্ধে আজ যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে বিশ্ববাসী। যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে দেশবাসীও।

একাত্তরে জীবন বাজি রেখে ‘সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি-তত্ত্বের' ভাইরাস এবং তার বাহক ‘ঘাতক হানাদার বাহিনী’র বিরুদ্ধে যুদ্ধে করে আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম। ‘করোনা ভাইরাসের’ বিরুদ্ধে এখনকার এই যুদ্ধেও আমাদের বিজয়ী হতে হবে। এটি আজ আমাদের পবিত্র দেশপ্রেমিক ও মানবিক কর্তব্য।

‘কোভিড-১৯’-এর কোনো প্রতিষেধক, অথবা তার কোনো পরীক্ষিত ওষুধ এখনো উদ্ভাবিত হয়নি। এ জন্য আরও সময় লাগবে। কত সময় লাগবে, সে কথা কারও জানা নেই। এদিকে, করোনার ছোবলে মানুষের মৃত্যুর মিছিল থেমে নেই। দেশে-দেশে ঝাঁকে-ঝাঁকে মানুষ মরে চলেছে। এ মৃত্যু রোধ করা যাচ্ছে না। তবে সংক্রমণের ও মৃতের সংখ্যা সীমিত রাখা কিছুটা সম্ভব করে তোলা যাচ্ছে। সেজন্য রোগটির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তা করা যে কিছুটা সম্ভব- সে কথার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। যথাসম্ভব সব উপায়ে রোগটির বিস্তার রোধের চেষ্টা করাটিই তাই এখন হয়ে রয়েছে এ ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান কর্তব্য।

‘কোভিড-১৯’ মোকাবেলায় তার বিস্তার রোধের জন্য মানুষের পক্ষে এখন যেটি প্রধান করণীয় হয়ে উঠেছে তা হলো- মানুষের মধ্যে পরস্পরের দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখা। এটিকে আক্ষায়িত করা হচ্ছে ‘সামাজিক দূরত্ব বাড়ানো’ (Social Distancing) বলে। এ শব্দচয়নটি যথাযথ নয়। কারণ, তা এক ধরনের গুরুতর ভুল ও উল্টো রকম ধারণার জন্ম দেয়। কারণ, ‘সামাজিক দায়িত্ব' ও ‘সামাজিক বন্ধন’ আরও বাড়ানোটিই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি ও অপরিহার্য। সেক্ষেত্রে ‘কোভিড-১৯’ মোকাবিলায় মানুষে-মানুষে ‘সামাজিক দূরত্ব' বাড়ানোর কথা বলাটি হবে আত্মঘাতি।

এ কথা আজ পরিস্কার হয়ে গেছে যে ‘কোভিড-১৯’ মহামারী থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব হতে পারে কেবল ‘সমষ্টিগতভাবে’। বিচ্ছিন্নভাবে ও এককভাবে কোনো ব্যক্তির অথবা গোষ্ঠীর পক্ষে এই মহামারীর আক্রমণ থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব নয়। তাই বর্তমানে যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো ‘সামাজিক সহযোগিতা-সংহতি বাড়ানো’ (Enhancement of Social Integration)। ‘সামাজিক সংহতির’ (Social Integration)-এর তাগিদ থেকেই ‘দৈহিক দূরত্ব’ (Physical Distancing) বজায় রাখার কর্তব্য এখন ও এই মুহূর্তে বিশেষভাবে জরুরি হয়ে উঠেছে।

অসুখ হলে তা নিরাময়ের জন্য ঔষুধ খেতে হয়। কিন্তু ঔষুধের ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিবারণের ব্যবস্থা না করলে রোগীর আরও বেশি ক্ষতি হওয়ার বিপদ থাকে। কোনো কোনো ঔষুধের ক্ষেত্রে মূল ঔষুধ খাওয়ার ৩০ মিনিট আগে ‘গ্যাস্ট্রিকের’ ঔষুধ খেয়ে নিতে হয়। আমাকেও ‘ইকোস্প্রিন’ খাওয়ার আগে ‘লোসেক্টিল’ খেয়ে নিতে হয়। ‘কোভিড-১৯’ মোকাবিলার ক্ষেত্রেও তেমনি ঔষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জেনে নতুন আরো বিপদের জন্ম না দেয়, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।

‘কোভিড-১৯’ মোকাবেলায় এখনো পর্যন্ত প্রধান ‘ঔষুধ’ হলো ‘দৈহিক দূরত্ব’ (Physical Distancing) বজায় রাখা। এবং সেজন্য জনগণকে কিছুদিন ‘ঘরে আবদ্ধ রাখার’ ব্যবস্থা করা। ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা। কিন্তু এর ফলে ‘দিন আনি দিন খাওয়া’ বহু মানুষ আজ তাদের আয়-উপার্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে অগণিত পরিবার অনাহারের বিপদে নিপতিত হয়েছে। এটিও একই রকম এবং দৃশ্যমান একটি বিপদ। তাই, ‘অনাহারে মৃত্যুর’ আশঙ্কায় থাকা মানুষের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করাও আজ ‘নিজে ঘরে আবদ্ধ রাখার’ মতো সমান গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে উঠেছে।

এ জন্যই ক্ষুধার্ত ও নাজুক (Uvlnerable) পরিবারগুলোকে সেনা সহায়তায় ‘রেশন কার্ডের’ মতো ‘ফুড কার্ড’ প্রদান করে, আগামি ৩ মাস ধরে সরকারিভাবে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী প্রদানের ব্যবস্থা করা আজ অপরিহার্য। এটি যদি প্রথম থেকে করা হতো তা হলে ‘দিন আনি দিন খাওয়া’ মানুষরা ‘ক্ষুধায় মরতে হবে না’ এই মর্মে নিশ্চিত হতে পারতো এবং তাদেরকে জীবিকার জন্য বাড়ির বাইরে যাওয়ার জন্য ভাবতে হতো না। সবার জন্য খাদ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানের এ কাজটি যথাযথভাবে করতে না পারায় ‘লকডাউন’ কার্যকর করা যাচ্ছে না, হবেও না।

দেশে আগে থেকেই ‘রেশনিং ব্যবস্থা’ এবং শক্তিশালী ‘গণবণ্টন ব্যবস্থা’ থাকলে ‘ফুড কার্ডের’ মাধ্যমে প্রতিটি পরিবারের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজটি সহজে ও দ্রুত করা যেত। ভবিষ্যতে স্থায়ীভাবে ‘রেশনিং ব্যবস্থা’ চালু করার চিন্তা তাই এখন থেকেই মাথায় রাখতে হবে।

ক্ষুধার্ত পরিবারগুলোকে বাঁচানোর জন্য বেসরকারিভাবেও ‘নাগরিক উদ্যোগ’ পরিচালনা করতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন গণসংগঠনসহ রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তিদের দ্বারা চাল-ডাল ইত্যাদি সংগ্রহ করে তা ক্ষুধার্তদের পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টা উৎসাহিত এবং সেসব উদ্যোগকে যথাসম্ভব সমন্বয় করার চেষ্টা করতে হবে।

‘কোভিড-১৯ মহামারী’র কারণে ২৩ মার্চ থেকে সরকার ঘোষিত ‘জাতীয় ছুটি’ চলছে। দেশের সব নাগরিককে ‘বাসায় থাকতে’ বলা হয়েছে। যানবাহন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকাংশ দেশের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন।

‘জাতীয় ছুটি’ চলতে থাকা অবস্থাতেই ৪ এপ্রিল গার্মেন্টস কারখানা খুলে দেওয়ার নোটিশ জারি করা হয়েছিল। চাকরি হারানোর ভয়ে গ্রামে চলে যাওয়া সেসব লক্ষ-লক্ষ শ্রমিকদেরকে ভিড় করে পায়ে হেঁটে অথবা ট্রাকে গাদাগাদি করে কর্মস্থলে ফিরতে হয়েছিল। তীব্র প্রতিবাদের মুখে ‘মুনাফালোভী’ মালিকরা শেষ পর্যন্ত তাদের কারখানা চালু করতে পারেনি। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। ‘করোনার আঘাত’ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার বিপদ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ হেন ‘তুগলকি’ কা্রবারের দায় তাদেরই নিতে হবে, যারা এ ধরনের ‘তুগলকি’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

অথচ দেশের ৫০ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকদেরকে এক মাসের সবেতন ছুটি দিলে সেজন্য মোট ৩ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হতো। সেটি প্রদান করা সম্ভব ছিল, এবং এখনো তা সম্ভব। কারণ এর চেয়ে বেশি টাকা অনুদান হিসাবে দেয়ার কথা প্রধানমন্ত্রী আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন।

‘কোভিড-১৯ মহামারী’র কারণে ঘটে যাওয়া দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে তুলতে সরকার অনুদান ও প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে তা হলো, এই টাকা শেষ পর্যন্ত কার বা কাদের পকেটে যাবে। এটি খুবই গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন একারণে যে, ‘কোভিড-১৯ মহামারীর’ কি দেশের ১% লুটেরা কোটিপতিদেরকে তাদের বিত্ত-বৈভব আরও বৃদ্ধি করার সুযোগ করে দিবে, না কি তা দেশের সম্পদের আরও ‘সমতামুখীন’ ও ‘গরিব-মধ্যবিত্ত অভিমুখীন’ পূনর্বণ্টনের পথ করে দিবে, তা এই প্রশ্নের জবাবের ওপরেই নির্ভর করছে। এ প্রশ্নে বিরোধই হলো ‘কোভিড-১৯ মহামারীকে’ কেন্দ্র করে ১% লুটেরা গোষ্ঠি বনাম ৯৯% শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত জনগণের মধ্যে ‘শ্রেণি দ্বন্দ্বের’ উৎস।

এ বিষয়ে যা বলতে হয় তা হলো এই যে, দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি, অর্থনীতির ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও তাদের ওপরেই প্রধানত নির্ভর করতে হবে। তাই ‘সরকারি অনুদান ও প্রণোদনা' তাদেরকেই দেয়া উচিৎ। এখন দেখা যাক, দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান কাদের?

এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, আমাদের দেশের অর্থনীতি টিকে থাকতে পারছে প্রধানত সমাজের তিনটি অংশের অবদানের বিনিময়ে। তারা হলো- ক.) মেহনতি কৃষক; খ.) গার্মেন্টসসহ শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষ এবং গ.) বিদেশে কর্মরত শ্রমিক কর্মচারী। সুতরাং এটিই হলো যুক্তির কথা যে, সরকার ঘোষিত অনুদান ও প্রণোদনার অর্থের প্রধান অংশ সরাসরি তাদেরকে প্রদান করলেই সবচেয়ে ভালোভাবে ‘কোভিড-১৯’ মহামারীজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যাবে। এবং সেটিই করা উচিৎ হবে।

এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ‘বিনিয়োগ’ ছাড়া ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা কি সম্ভব? তাই প্রণোদনা যদি দিতে হয় তাহলে তা দিতে হবে প্রধানত দেশের ‘বিনিয়োগকারী’ শ্রেণিকে। শ্রমিক বা কৃষককে না। কিন্তু কথা হলো, বিনিয়োগকারী কারা? সমাজের কোন অংশের মানুষ এ দেশের সবচেয়ে বড় ‘বিনিয়োগকারী’? তারা কি শুধু লক্ষ-কোটি টাকার মালিক ব্যক্তি খাতের ‘লুটেরা বিত্তবানরা’? না! মোটেই তা নয়! এ দেশে সবচেয়ে বড় ‘বিনিয়োগকারী’ ও সবচেয়ে বড় ‘ব্যক্তি খাত’ হলো ‘কৃষি’। তাই ‘বিনিয়োগকারী’ ও ‘ব্যক্তি খাত’- এই উভয় বিবেচনায়ই অনুদান ও প্রণোদনার প্রধান ও বড় অংশ কৃষি ও কৃষকেরই প্রাপ্য।

আমাদের দেশে অর্থনীতির আরেকটি বড় অংশ এখনো ‘স্বনিয়োজিত’ ও ‘খুদে’ বিনিয়োগকারীর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এদের এবং এমনকি মাঝারি বিনিয়োগকারী ‘উদ্যোক্তা শ্রেণির’ও অর্থনৈতিক শক্তি পুনরুদ্ধারে ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে। তাদেরকে প্রণোদনার অর্থ প্রদান করলে তা কাজে আসবে।

কৃষির সঙ্গে জড়িত মানুষের সংখ্যাই এ দেশে সবচেয়ে বেশি। এদের সঙ্গে গার্মেন্টসসহ শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষদের সংখ্যা যুক্ত করলে এরাই হবে দেশবাসীর ৯০ শতাংশের ওপর। এই ৯০ শতাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারার ওপরই নির্ভর করবে অর্থনীতির চাঙ্গা হয়ে ওঠা। অনুদান ও প্রণোদনার টাকার সিংহভাগ এদেরই প্রাপ্য। এই প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারলেই ‘কোভিড-১৯ মহামারী’ জনিত অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার কাজটি সবচেয়ে সহজে, সবচেয়ে দ্রুত, সবচেয়ে জনকল্যাণমূলকভাবে ও সবচেয়ে নিশ্চিতভাবে সম্ভব হবে।

অনুদান ও প্রণোদনার প্রধান অংশ সরাসরি এদের না দিয়ে তা যদি হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক ‘লুটেরা বিত্তবানদের’ দেওয়া হয়, তা হলে সে টাকার বেশিরভাগটাই যে তারা বিদেশে পাচার করে দেবে, এবং ভোগ-বিলাসে অপচয় করবে, সে কথা অভিজ্ঞতার আলোকে নিশ্চিত বলা যায়। ‘কোভিড-১৯ মহামারী’ লুটেরাদের লুটপাটের উৎস ও সুযোগে পরিণত করার চেষ্টাকে সফল হতে দেওয়া যায় না।

‘কোভিড-১৯’-এর বিস্তার যেন না ঘটে, তা নিশ্চিত করা এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ। কিন্তু একই সঙ্গে দেশের ‘খাদ্যনিরাপত্তা’ নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ দিকে নজর না দিলে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়ার বিপদ সৃষ্টি হবে। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এমতাবস্থায় নিম্নোক্ত কাজগুলো পরিচালনার জন্য এখনই উদ্যোগ নেওয়া বিশেষভাবে জরুরি।

১) গ্রামাঞ্চলে বোরো ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। ধান কাটা শুরু হওয়ার আগেই করোনার আগ্রাসন মোকাবেলার জন্য সারাদেশের প্রতিটি গ্রামে, গ্রামবাসীদের আস্থাভাজন মানুষদেরকে সামনে রেখে, ‘গ্রাম সুরক্ষা কমিটি’ (বা এ ধরনের কোনো নামে), গঠন করে গ্রামবাসীদের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণে তৎপর হওয়া।

২) সরকারি বরাদ্দ যেন ‘উপযুক্ত পরিবার’ ছাড়া অন্য কারও হাতে না যায়, তা নিশ্চিত করা।

৩) 'গ্রামের কোন মানুষকে না খেয়ে মরতে দিব না'- এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে চাল-ডাল ইত্যাদি দ্রব্যাদির আপৎকালীন মজুদ হিসাবে 'জনভাণ্ডার’ গড়ে তোলা। ক্ষুধার্ত পরিবারগুলোকে তা পৌঁছে দেওয়া।

৪) মানুষরা যেন গ্রামে ঢোকার মুখে প্রতিবার হাত ধুয়ে গ্রামে প্রবেশ করেন, তা নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত স্থানে সাবান, পানি, গামছা ইত্যাদি রাখার ব্যবস্থা করা।

৫) প্রাথমিক চিকিৎসা সহায়তার জন্য এলাকার ডাক্তার, কম্পাউন্ডার, কবিরাজ, প্রমুখদেরকে সজাগ রাখা, ঔষুধের দোকান খোলা রাখার ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয় দেখভাল করা। উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে কোথায় যোগাযোগ করতে হবে তা আগে থেকে জেনে রাখা। ...ইত্যাদি।

৬) শহরের পাড়ামহল্লাগুলোতেও স্থানীয়ভাবে একই রকমের উদ্যোগ নেওয়া।

৭) শ্রমিকের ঘাটতি থাকা এলাকায় অন্য এলাকা থেকে ধান কাটার লোক আনার জন্য সরকারিভাবে সব বিআরটিসি বাস রিকুইজিশন করে সেগুলোর উপযুক্ত ‘স্যানিটেশনের’ সুরক্ষা ব্যবস্থা সহকারে ক্ষেতমজুরদের নিয়ে আসা ও কাজ শেষে বাড়ি ফিরে যাওয়ার আয়োজন করা। তাছাড়া, গ্রামের মানুষরা পরস্পর সহযোগিতা করে পালাক্রমে পরস্পরের জমির ধান কেটে আনার ব্যবস্থা করা।... ইত্যাদি।

এ ধরনের আরও অনেক সৃজনশীল গণ-উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ‘ব্যক্তিগত মুনাফার প্রনোদনাকে’ ভিত্তি করে পরিচালিত পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা বহাল রেখে সেসব কাজ করা যে সম্ভব নয়, এই সত্যটি আজ চূড়ান্তভাবে খোলাসা হয়ে গেছে। তাই দেখা যাচ্ছে যে চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, নেপাল, ভারতের কেরালা রাজ্য প্রভৃতি যেসব জায়গায় কমিউনিস্ট সরকার আছে সেসব জায়গায় যেভাবে ও যতোটা দক্ষতার সাথে ‘কোভিড-১৯’-এর মহামারি মোকাবেলা করা গেছে, পুঁজিবাদী বিশ্বের দেশগুলোতে তা করা সম্ভব নয়। মার্কসবাদের বৈজ্ঞানিক মতবাদ, মেহনতি মানুষের শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি, কমিউনিস্টদের ‘বিপ্লবী মানবতাবাদ’ ইত্যাদির কারণে যা তাদের পক্ষে করা সম্ভব হয়েছে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পক্ষে তা করতে পারা সম্ভব নয়।

পুঁজিবাদের ‘ব্যক্তিভিত্তিক’ ও ‘মুনাফাভিত্তিক’ ব্যবস্থার নৈরাজ্য ও কুফল আজ ‘কোভিড-১৯’ মহামারীকে কেন্দ্র সৃষ্টি হওয়া ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এ কথা আজ স্পষ্ট যে, এহেন দুর্গতি থেকে রক্ষা পেতে হলে বিশ্বকে আগামীতে ‘পুঁজিবাদের চেনা পথের’ বাইরে হাঁটতে হবে। করোনা মহামারির বিরুদ্ধে সংগ্রামের অভিজ্ঞতার আলোকে মানুষের মধ্যে ‘সামাজিক’ বোধ ও চেতনা এবং ‘সমাজতন্ত্রের’ প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উপলব্ধি জোরদার হচ্ছে। করোনা প্রতিরোধের সংগ্রাম আজ তাই বিশ্ববাসীর ‘বিপ্লবী সংগ্রামেরই’ অংশ হয়ে উঠেছে।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন