শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ , ১১ জুমাদাউস সানি ১৪৪৬

ফিচার
  >
ইতিহাস ও ঐতিহ্য

আজ মোগল সম্রাট আকবরের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

নিউজজি ডেস্ক ২৭ অক্টোবর , ২০২৪, ১১:৫৯:৩৮

76
  • ছবি: ইন্টারনেট

ঢাকা: আকবরকে অনেক ঐতিহাসিক মুঘল সম্রাটদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মনে করেন ও তাকে ‘আকবর দ্য গ্রেট’ বলে আখ্যায়িত করেন। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় গুরুতর চোট লাগার ফলে তার বাবা মুঘল সম্রাট নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুনের মৃত্যু হয়। মাত্র ১৩ বছর বয়সে অভিষেক হয় আকবরের। তখনো মুঘল সাম্রাজ্যের এতটা বিস্তার হয়নি। কিশোর আকবরের জন্য তাই সময়টা ছিল কঠিন।

পাঞ্জাবে মুঘল সেনারা আফগান সিকান্দার শূরকে পরাজিত করলেও তিনি তখনো সক্রিয় ছিলেন, পূর্ব-উত্তর ভারতে এবং বিহারে তখন সুলতান আদিল শাহর রাজত্ব ছিল। বাংলায় তখন ছিলেন সুলতান মুহাম্মদ খান শূর। এমনকি হুমায়ুনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই জালাল শাহ শূর জৈনপুর থেকে ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে দিল্লি আক্রমণের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হচ্ছিলেন।

ওই সংকটময় পরিস্থিতিতে জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেন। দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৫৫৬। সিংহাসনের আরোহণের পর তিনি নিজের সিপাহসালার প্রধান, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বৈরাম খানকে নিযুক্ত করেন, যিনি ছিলেন হুমায়ুনের বিশ্বস্তজনদের একজন এবং আকবরের গুরু (যাকে আকবর খান বাবা বলে ডাকতেন)।

আকবরের জীবনে বৈরাম খানের যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পানিপথের যুদ্ধ ও অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে মুঘল সাম্রাজ্য বৈরাম খানের সুনিপুণ কৌশলের জন্য জয়ী হয়।

১৫৫৬-১৫৬০ পর্যন্ত মুঘল সম্রাজ্যের ওপর বৈরাম খানের একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার হয়। কিন্তু বাদশা আকবরের দুধমাতা মাহিম আঙ্গারের সঙ্গে বিরোধ ও আকবরের মধ্যকার স্বাধীন মতামত প্রয়োগের আকাঙ্ক্ষার ফলে তিনি বৈরাম খানকে পদচ্যুত করেন এবং সমস্ত ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেন। নির্দেশ প্রদানপূর্বক বৈরাম খানকে হজে পাঠিয়ে দেন আকবর। কিন্তু তিনি গুজরাটে পৌঁছানোর সময় আততায়ীর হাতে খুন হন।

ওই ঘটনার পর আকবরের মহলে মাহিম আঙ্গার প্রভাব চলতে শুরু করে। তার কথায় মুনিম খানকে উজির করা হয়। তার ছেলে আধহাম খান রাজ্যবিস্তারের নামে চরমভাবে লুটপাট শুরু করেন।

আধহাম খান বাদশাহ আকবরের আনুগত্য মেনে নিতে পারছিলেন না। আকবর সমস্ত বিষয় বুঝতে পেরে শক্ত হাতে ক্ষমতা পরিচালনা করেন। তিনি মুনিম খানকে সরিয়ে শামসুদ্দিন আদখা খাঁকে উজির নিযুক্ত করেন, যাকে আধহাম খান হত্যা করেন। বাদশাহ আকবর তা জানতে পেরে আধহাম খানকে ছাদ থেকে ফেলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আদেশ দেন। এই ঘটনার কিছুদিন পর মাহিম আঙ্গারের মৃত্যু হয়।

আকবর রাজ্যবিস্তারের ব্যাপারে শক্তির পাশাপাশি অন্য কৌশলগুলোর দিকেও লক্ষ্য রাখেন। তিনি ভারতবর্ষের বিখ্যাত যোদ্ধা জাতি রাজপুতদের অনেক রাজাদের সঙ্গে সম্বন্ধ করেন তাদের মেয়েদের বিয়ে করার মধ্য দিয়ে। এভাবে আকবরের রাজ্য সহজভাবে বিস্তার লাভ করে, তার শাসনের ভিত আরও পাকাপোক্ত হয়।

ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় তৎকালীন ভারতবর্ষে আকবর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তখনকার মৌলভী ও ইতিহাসবেত্তা আবদুল কাদের লিখেছেন, আকবর তার হিন্দু স্ত্রীদের সঙ্গে যজ্ঞের আয়োজন করতেন এবং রাজপুত স্ত্রীরা তাদের মহলে পূজা-পাঠ করতেন। এই সময় তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করেন। একটি হলো হিন্দুদের তীর্থযাত্রায় যাওয়ার জন্য যে কর দিতে হতো, তা মওকুফ করেন। অন্যদিকে তিনি অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর আরোপিত জিজিয়া করও মওকুফ করেন।

এই সময় আকবর কট্টরপন্থি সুন্নি ধর্মগুরুদের থেকে দূরে সরে আসেন এবং একটি ইবাদতখানা তৈরি করেন, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের গুরুরা ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করতেন এবং পরস্পর মতবিনিময় করতেন। আকবরের মনে বিশ্বাস ছিল যে, ধর্মের নামে সহিংসতা ও লড়াই কোনো মতাদর্শই সমর্থন করে না। কিন্তু ধর্মীয় কেন্দ্রগুলোতে আলেম- ওলামারা ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত থাকতেন। সেখানে মতবিনিময়ের বদলে বিবাদ বেশি হতো এবং এই বিবাদ দেখে দেখে আকবর অত্যন্ত বিরক্ত হতে থাকলেন। তিনি ধর্মগুরুদের স্বার্থপরতা ও তাদের আসল রূপ চিনতে পারলেন।

১৫৮১ কিংবা ৮২ সালের দিকে আকবর ইবাদতখানা বন্ধ করে দেন। তিনি এতদিন ধরে মাওলানা ও মৌলভীদের কথা মানার জন্য অনুতাপ বোধ করেন। রাজনৈতিক কারণে ও আলেম-ওলামাদের ধর্মব্যবসা, স্বার্থপরতা ও কূপমণ্ডূকতা দেখে তিনি তার সনাতনধর্মী উপদেষ্টাদের পরামর্শে নতুন এক ধর্মীয় মতাদর্শের জন্ম দেন, যার নাম পরবর্তী সময়ে মাওলানারা দীনে এলাহি হিসাবে প্রচার করে থাকেন।

আকবর বুঝতে পারেন, ধর্মগুরুরা নিজেদের স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করেন। তিনি এ-ও উপলব্ধি করেন যে, সব ধর্মই এক স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু তার প্রবর্তিত ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান ছিল খুবই পক্ষপাতদুষ্ট ও অদ্ভুত।

দীনি এলাহি চালুর পর সম্রাটের বিরুদ্ধে কিছু সুবেদার বিদ্রোহ করেন ও তার ছোট ভাই মির্জা হাকিমকে সম্রাট ঘোষণা করেন, যাতে কিছু মাওলানা ও মৌলভীর সমর্থন ছিল। আকবর শক্ত হাতে এই বিদ্রোহ দমন করেন ও তার ধর্মীয় উপলব্ধির বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে থাকেন।

সম্রাট আকবর বিভিন্ন গ্রন্থ অনুবাদ করান, যার মধ্যে হিন্দু পুরাণ, মহাভারত উল্লেখযোগ্য। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের একটি পরিপূর্ণ শাসননীতি প্রবর্তন করে যান, যা আওরঙ্গজেব পর্যন্ত টিকে ছিল। কিন্তু তার শেষ সময় ভালো কাটেনি।

আকবরের জীবদ্দশায় তার দুই ছেলের মৃত্যু হয়। ছেলে সেলিম তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ২৭ অক্টোবর ১৬০৫, মধ্যরাতে জিল্লে এলাহি জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবরের মৃত্যু হয়।

নিউজজি/ পি.এম

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন