মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ , ২১ রজব ১৪৪৬

ফিচার
  >
ইতিহাস ও ঐতিহ্য

সুরের পেয়ালা হাতে এখনও পাশেই আছেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়

নিউজজি প্রতিবেদক ১৩ ডিসেম্বর , ২০২৪, ১২:৪১:১৪

79
  • ছবি : সংগৃহীত

‘আকাশ এত মেঘলা’, ‘জীবনে যদি দ্বীপ’, ‘মরমীয়া তুমি’, ‘পাষাণের বুকে’, ‘ও আকাশ প্রদীপ’, ‘জানি একদিন আমার জীবনী লেখা হবে’, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি’, ‘কত না হাজার ফুল’, ‘হায় বরষা’, ‘এখনও আকাশ’, ‘বন্ধু হয় অনেকে’, ‘আজ মনে হয় এই নিরালায় সারাদিন ছন্দের গান শুনি’, ‘যেদিন তোমায় আমি দেখেছি’এসব গান সতীনাথকে মনে করিয়ে দেয়। এসব গান আজও অনেকের মনে বাজে। আজও অনেকে সতীনাথের গানের সিডি খোঁজেন।

সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের এসব গান আজও অনেককেই ভীষণ নাড়া দিয়ে যায়। কোথাও এসব গানের রেকর্ড বাজলে, কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে অনেক প্রবীণের মুখ থেকেই অকপটে বেরিয়ে আসে ‘এগুলো হচ্ছে গান’। এই অমর শিল্পীর প্রয়াণ দিবস আজ।

সতীনাথ মুখোপাধ্যায় প্রয়াত হন ১৯৯২ সালের ১৩ ডিসেম্বর। কলকাতার পিজি হাসপাতালে বক্ষ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি হয়ে যান দূর আকাশের তারা। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯২৫ সালে ভারতের লখনৌতে। বাবার নাম তারকচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। পিতার চাকরিসূত্রে লখনৌতে জন্ম হলেও ছোটবেলাতেই সতীনাথ চলে আসেন হুগলির চুঁচুড়ায়। এখানেই তার বেড়ে ওঠা ও বিএ পর্যন্ত লেখাপড়া সম্পন্ন করেন। এরপর এমএ পড়ার জন্য চলে আসেন কলকাতায়। কলকাতায় এসে পড়া বাদ দিয়ে সতীনাথ চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা করেন। তিনি আধুনিক বাংলা গান, নজরুল সঙ্গীত ও গজল শিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। কণ্ঠশিল্পীর বাইরেও তিনি গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন।

গানের কোনো লাইন যখনই মনে আসতো তখনই লিখে ফেলতেন। গান মনে এল তো, সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে তাতেই কথা লিখেছেন। নোটেশন করেছেন। চাঁদনি রাতে গাড়িতে যেতে যেতে হঠাৎই লিখে ফেলছেন, ‘জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো’ কিংবা ‘এখনও আকাশে চাঁদ ওই জেগে আছে’।

পঞ্চাশ আর ষাট দশক ছিল অনেকের মতে বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগ। কথা ও সুর সেই সময়ে একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শ্রোতাদের মন জয় করেছিল। সুরকারদের মধ্যে ছিলেন সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্ত, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্রের মত দিকপালেরা। আর গীতিকার হিসেবে ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল ঘোষের মত প্রতিভাবান লেখকের দল।

ছোটবেলা থেকেই সতীনাথ সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন। সে সূত্রে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ধ্রুপদ-ধামার-টপ্পা শেখেন। তার ঠাকুরদা রামচন্দ্র বেহালা বাজাতেন ও বাবা তারকচন্দ্র গান গাইতেন। তবে কেউ পেশাদারি ছিলেন না। কর্মজীবনে যোগদান করেন কলকাতার অ্যাকাউন্টেন্স জেনারেল (এজি বেঙ্গল) এ। ১৯৬৮ সালে সতীনাথ সঙ্গীতশিল্পী উৎপলা সেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

নজরুলগীতিরও তিনি জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন। ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ সম্ভবত তার কণ্ঠেই প্রথম রেকর্ড হয়েছিল। ১৯৪২ সালে সতীনাথ প্রথম রেকর্ড করলেন নজরুলগীতির। ‘ভুল করে যদি ভাল বেসে থাকি’। তুমুল সাড়া পড়ে গেল। কিন্তু পরের গানের রেকর্ড ‘আমি চলে গেলে পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম’ আর ‘এ জীবনে যেন আজ কিছু ভাল লাগে না’ যখন বেরোল, তত দিনে পেরিয়ে গেছে দশটি বছর!

তাকে নিয়ে ছড়িয়ে আছে মজার মজার গল্প। একটি এমন—সময়টা পঞ্চাশের শুরু। কলকাতার এক বিখ্যাত জলসার আসর। উস্তাদজির গানের পর মঞ্চে উঠবেন লতা মঙ্গেশকর। এই দুই শিল্পীর মাঝখানের সময়টুকু ভরাট করতে গান গাইতে বসবেন এমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।

সতীনাথ এগিয়ে এলেন। সদ্য যুবক। আহীর-ভৈঁরো রাগে ধরলেন ‘না যেও না গো চলে যেয়ো না’। গান শেষ হতে শ্রোতারা উচ্ছ্বসিত। ‘এনকোর এনকোর’। তন্ময় সতীনাথ শুনলেন ‘নো মোর নো মোর’। উঠে পড়তে যাচ্ছিলেন। ভুল ভাঙাতে মঞ্চে উঠে এলেন লতাজি। গ্রিন রুমে জড়িয়ে ধরলেন উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি। বলেন, ‘তুমি সতীনাথ নও, শিউনাথ (শিব)।’

আবার—রান্নার পাশাপাশি জমিয়ে বাজারও করতেন সতীনাথ। নিউ মার্কেটে তার বাঁধা মুরগিওয়ালা ছিলেন আলাউদ্দিন। উর্দুভাষী। আর নিজে উর্দুটা যেহেতু বলতে, লিখতে পারতেন, সতীনাথ তার সঙ্গে উর্দুতেই কথা বলতেন। সে-উর্দু এতটাই চোস্ত ছিল, আলাউদ্দিন ধরেই নিয়েছিলেন তার খদ্দের বাবুটি মুসলিম। কিন্তু তার খটকা লাগত অন্য জায়গায়। একদিন আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললেন, ‘আপ মুসলমান হোকে ধোতি কিঁউ প্যাহেনতে হ্যায়?’ শেষে গলার উপবীত দেখিয়ে তাকে বোঝানো গিয়েছিল, ‘না বাবা, আমি মুসলিম নই, হিন্দু ব্রাহ্মণ।’

উর্দুটা ভালো জানতেন বলে গজলটাও ভালো গাইতেন। ৪৭-এর আগে লাহোর-করাচিতে গজল গেয়ে বেড়াতেন গোলাম মুস্তাফা নামে। অনেকটা সেই কাশেম মল্লিক যেমন ভক্তিগীতি গাইতে গিয়ে কে মল্লিক হয়েছিলেন, তেমন। আরেকটি ঘটনা এমন—নতুন গানের সুর ভাঁজতে গিয়ে বেখেয়ালে নিয়ম ভেঙে থানাতেও গেছেন। ভুল পার্কিং করে ফেলেছিলেন। ট্রাফিক পুলিশ সোজা পার্ক স্ট্রিট থানায় ধরে নিয়ে যান। তাতেও হুঁশ নেই। থানার চেয়ারে বসে বসেই সুর লাগাচ্ছেন। গলা শুনে ওসি ছুটে এসে দেখেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়! তখন সেই ট্রাফিক পুলিশেরই সাজা হয় আরকী!

আরেকটি ঘটনা তো আরো অবাক করারই মতো—চল্লিশের দশক। হুগলি মহসিন কলেজে ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে। গোলকিপিং করছে যে ছেলেটি, সে মাঝে মাঝেই গুন গুন করে গান গায়। উপস্থিত দর্শক সতীনাথের কানে গেল। খেলা শেষে ছেলেটিকে ডেকে নিয়ে তিনি কলকাতায় গিয়ে ভালো গান শেখার পরামর্শ দিলেন। সে দিনের সেই গোলকিপার, পরবর্তী কালের শ্যামল মিত্র। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই চরম সত্যি।

নিউজজি/এস দত্ত/নাসি 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন