শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ , ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার
  >
ইতিহাস ও ঐতিহ্য

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিলাত প্রবাসীরা

নিউজজি ডেস্ক ২৬ মার্চ , ২০২২, ০০:২৩:৪২

265
  • মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিলাত প্রবাসীরা

ঢাকা: আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ একদিনে হয়নি। হয়নি একক প্রচেষ্টায়। এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল আপামর জনতা। সম্মুখ সমরে লড়াই করেছেন বাংলার দামাল ছেলেরা। তেমনি রণাঙ্গন থেকে দূরে, দেশের বাইরে বসবাস করা বাঙালিরা পালন করেছেন অনন্য ভূমিকা। নিজেদের জন্মভূমি স্বাধীন করার জন্য, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার করার জন্য প্রবাসীরা পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

বাঙালির প্রবাস যাত্রার পূর্বসূরি লন্ডনে বসবাসরত সিলেটীদের অবদান কারও এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদিও এ প্রবাসী বাংলাদেশিদের আক্ষেপে এখন উচ্চারিত হয় ভিন্ন কথা। আমাদের বিজয় গৌরব গাথায় তাদের কথা আর তেমন উচ্চারিত হয় না। স্মরণে আসে না ’৭১ সালে তাদের অবদানের কথাগুলো। কথা উঠলেই অভিমানে নিজেদের ক্ষোভের কথা অকপটে বলেন একাত্তরের প্রবাসী বন্ধুরা।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের খণ্ড খণ্ড অনেক অধ্যায় ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। বিলীন হতে চলছে মুক্তির ইতিহাসের গল্প। ভাষা আন্দোলন, ‘৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে মুক্তির প্রত্যাশায়। বাঙালি বর্বর পাকিস্তানিদের কামান মোকাবিলা করে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে। হাতে তুলে নেয় বাঁশের লাঠি। যার যা আছে—তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পরে মুক্তির লড়াইয়ে। বাঙালির জীবনযুদ্ধের এ ক্রান্তি লগ্নে পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দামাল বাঙালিরাও ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তির লড়াইয়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে নিজেদের তাঁরা যুক্ত করেন। পশ্চিমের নানান দেশে থাকা প্রবাসীরা সে সময় ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিটিং-মিছিল করেছেন। সে সময়ের প্রবাসী বাংলাদেশিদের আন্দোলন বিদেশিদের নজর কাড়ে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে প্রবাসীদের এমন ভূমিকা ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। বিদেশি সাধারণ মানুষও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সাধারণ প্রবাসীদের সঙ্গে। লন্ডনের হাইড পার্ক থেকে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে বিশ্ব সেদিনই শুনেছিল অজেয় বাঙালির গর্জন। বিদেশিরাও সেদিন জয়বাংলা উচ্চারণ করে বাঙালিকে সমর্থন জানায়। 

 লন্ডনে আমেরিকার বড় বড় শহরের প্রবাসী বাংলাদেশিরা সাহায্যের আবেদন করেছেন। দল বেঁধে বিপন্ন স্বজাতির মুক্তির লড়াইয়ে চাঁদা উঠিয়ে অর্থ সাহায্য করেছেন। বিদেশিরা সেসময় সাড়া দিয়েছে বাঙালির মুক্তির মানবিক লড়াইয়ে। একাত্তরের প্রবাসীদের কাছ থেকে জানা গেছে, বর্বর পাকিস্তানের প্রবাসীরা ব্রিটেন আমেরিকায় প্রবাসী-বাংলাদেশিদের ওপর হামলা করেছে সে সময়। প্রবাসী বাঙালির মিছিল সমাবেশ দেখলে পাকিস্তানিরা গালাগাল করত। লন্ডন ও নিউইয়র্কে কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছে পাকিস্তানিদের সঙ্গে। বেশ কয়েকজন প্রবাসী মারামারি করে জেলে পর্যন্ত গিয়েছেন। 

একাত্তরের ক্রান্তিকালীন সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অধিকাংশই ছিলেন সিলেট অঞ্চলের। লন্ডনের প্রবাসী বলতে সিলেটীরা। আমেরিকায়ও তখন সিংহভাগ প্রবাসী ছিলেন সিলেটের। বাংলাদেশর মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রবাসী সিলেটের লোকজনের কথা আজ আর আলাদাভাবে উচ্চারিত হয় না । 

 লন্ডনে অনেক মা তার শিশুর জন্য দুধ কেনার অর্থ বাঁচিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য অর্থ সাহায্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে অনুদান দিয়েছেন। লন্ডনে অবস্থানরত হাজার হাজার পরিবারের স্মৃতিতে এখনো জলজল করে মুক্তিযুদ্ধের সে সময়ের কথা। শুধু তাঁরা নিজেরা দিয়েছেন তা নয়, তহবিলও সংগ্রহ করেছেন। প্রবাসের প্রতিকূল জীবনে কাজ কর্ম বিসর্জন দিয়ে চাঁদা উঠিয়েছেন, সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। 

’৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারত-পাকিস্তানের মুক্তির আগে থেকেই সিলেট অঞ্চলের লোকজন প্রবাসে নোঙর করেছেন। ‘৪৭পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সরকার তাদের কর্মী সংকট সামাল দিতে ভাউচারের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান থেকে লন্ডনে লোক নেওয়ার পরিকল্পনা করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তারা এলাকা যাচাইয়ের মাধ্যমে সিলেটকে তাদের পছন্দের তালিকাভুক্ত করে এবং ভাউচার বিতরণ করলে সিলেটীরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। পাকিস্তানের শাসনকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বিদেশে যাওয়ার পথ সংকুচিত ছিল। বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীকে সুযোগ দেওয়া হতো বেশি করে। এতেও ছিল বৈষম্য। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর মধ্যপ্রাচ্যের দরজা উন্মুক্ত হয়। সে সময় মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার পর দেখা যায়, পাকিস্তানিরা যুগের পর যুগ ধরে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অবস্থান দৃঢ় করেছে। ব্রিটিশ সরকারের একটি সুযোগ সিলেটবাসীর ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। ‘বিলাত’ প্রবাসী এই সিলেটীরাই জাতির সবচেয়ে কঠিন সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলার মাটির খাঁটি সন্তানেরা। 

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু লন্ডনে নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় লন্ডনে অবস্থানরত সিলেটিদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হবে এসব প্রবাসীদের নাম। বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো আজও স্মরণে আছে প্রবীণ প্রবাসীদের। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাকালে এ গৌরবগাথা ঠিকই উচ্চারিত হতো। উচ্চারিত হতো শ্রদ্ধায় আর বিনয়ের সঙ্গে।

 এখন তা আর তেমন উচ্চারিত হয় না। লন্ডনের বসবাসরত সিলেটের প্রবীণ প্রবাসীরা তাদের মর্মবেদনার কথা জানালেন। পূর্ব লন্ডনের বাবুল রহমান, হোসেন খান, মুহিব রহমান, পংকি মিয়া, আসিক মিয়া, লুটনের আনোয়ারুল হক জবা, খালেদ আহমেদ, আজির উদ্দিন, মিনহাজ চৌধুরী, আমীরুল ইসলাম বাচ্চু, ফয়সল আহমেদ, শাহান আহমেদ, সউদ চৌধুরী, নানু মিয়াসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে মুক্ত আলোচনায় তারা দুঃখ প্রকাশ করলেন। পরিতাপের সঙ্গে আলাপচারিতায় তাদের খেদোক্তি, এখন আর আমাদের সিলেটের লন্ডনপ্রবাসীদের মূল্যায়ন করা হয় না। নেতাদের মুখে আমাদের নাম আর উচ্চারিত হয় না। 

স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যাংকের প্রথম বৈদেশিক মুদ্রার জোগানদাতা সিলেটের ব্রিটেন প্রবাসীদের মূল্যায়ন করা হোক। মুক্তিযুদ্ধের আলোচনায় তাদের অবদান উচ্চারিত হোক- এ প্রত্যাশাটুকু তাঁরা করতেই পারেন।

সূত্র: ইন্টারনেট

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন