বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৭ ফাল্গুন ১৪৩১ , ২০ শাবান ১৪৪৬

ফিচার
  >
মানচিত্র

‘পাহাড়ি জাতির ভূমি’ মিজোরাম

নিউজজি ডেস্ক ২৩ আগস্ট , ২০২৩, ১৫:১৬:৫৬

654
  • ছবি: ইন্টারনেট

ঢাকা: মিজোরাম। উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য। মিজোরামের রাজধানী নাম আইজল। ভারতের উত্তর-পূর্বে, এটি সর্বদক্ষিণের স্থলবেষ্টিত রাজ্য এবং ভারতের সাত বোন রাজ্যের ত্রিপুরা, আসাম, মণিপুর এই তিনটি রাজ্যের সাথে যার সীমানা রয়েছে। এছাড়াও প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের প্রায় ৭২২ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে মিজোরামের সীমানা অবস্থিত।

মি (জাতি), জো (পাহাড়) এবং রাম (ভূমি), এই তিনটি শব্দ থেকে উদ্ভূত মিজোরাম বলতে "পাহাড়ি জাতির ভূমি" বোঝায়।

মিজোদের উৎপত্তি, ভারতের উত্তর-পূর্বের অন্যান্য আদিবাসীদের মতো রহস্যময়। কিন্তু গৃহীত ধারণা থেকে জানা যায়, তারা মায়ানমারের একটা অংশ, চায়না থেকে বার্মা যাওয়া লোকজনই মূলত মিজো। বৃহত্তর মঙ্গোলিয়ান জাতির অংশ তারা। পশ্চিম মায়ানমারে তারা ১ হাজার বছর ধরে আছে বলে ধারণা করা হয়। প্রকৃত পক্ষে মায়ানমারে পশ্চিমাংশে মিজোরা ৭ম শতাব্দিতে অভিবাসিত হয়। মিজোরা যাযাবরদের ন্যায় নতুন নতুন স্থানে গমন করার ফলে অন্যান্য প্রতিবেশী উপজাতিদের সাথে দ্বন্দ্বসংঘাত লেগে থাকত।

তাই তারা ১৫ শতকের শেষ দিকে সামাজিক উন্নয়ন ও শৃংখলার জন্য ঈযরবভঃধরহংযরঢ় চালু করে একজনকে গোত্র প্রধান মনোনীত করে। এটি পরে উত্তরাধিকার সূত্রে বড় ছেলে বা বড় পুত্র ঈযরবভঃধরহংযরঢ় হতেন। প্রথম মিজো চিফ হলেন একজন (খঁংবর) লুসাই। যার গোত্রীয় নাম তধযসঁধশধ। যামোয়াকার বংশধরেই পাহাড়ের এক বিশাল এলাকা দীর্ঘদিন শাসন করেন। পরে অষ্টাদশ শতাব্দিতে মিজোদের মায়ানমার থেকে বহির্গমন এক মহাকাব্যিক ব্যাপার, যা ভয়ংকর সংগ্রাম ও বীরত্বপূর্ণ ঘটনায় ভরা ছিল। একসময় তারা মায়ানমার সীমান্তের ঞরধঁ জরনবৎ অতিক্রম করে।

ব্রিটিশ ভারতবর্ষের আসামের কাছাড়, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেটের বিভিন্ন স্থানে ঝধরষড় (স্থানীয় লুসাই নেতা/মিজো নেতা) গণ ব্যাপক ধংসযজ্ঞ চালায়। এ সময় কাচার এলাকায় ব্রিটিশ সরকারের পরিচালিত চা-বাগানের এক শ্বেতাঙ্গ কর্মকর্তাকে হত্যা ও তার কন্যাকে অপহরণ করলে ক্ষুব্ধ ব্রিটিশ শাসক অভিযানের মাধ্যমে ধরে এনে মিজোদের একজন ঝধরষড়-কে কঠিন শাস্তি প্রদান করে। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ ঘটনা ঘটায়।

যামোয়াকার বংশধরেরাই এক সময় ঝধরষড় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং তেজী ও যোগ্য শাসক পরিগণিত হয়। তারা গ্রাম্য প্রশাসন ব্যবস্থা যথার্থ ভাবে চালু করতে সক্ষম হয়। গ্রাম্য প্রধানদেরকে তারা খধষ বলে অভিহিত করতেন এবং লালরাই গ্রামের ঝগড়া-বিবাদ নিরসন এবং চাষাবাদ কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।

এছাড়াও আশ্রয় প্রার্থীদের আশ্রয়ের এবং থাকার ব্যবস্থা করতেন। এই গ্রাম প্রধানদের কাজে সাহায্যে করতো প্রবীণদের নিয়ে গঠিত একটি পরিষদ। এই পরিষদকে টঢ়ধ বলা হতো। চার্চ এর পুরোহিত বা ধর্মগুরুদের এবং কামার, বিচারক নিয়োগ কার্যক্রমও পরিচালনা করতেন লালরা। চাল এবং মাংস দিয়ে এসব কর্মচারীদের পারিতোষিক বা বেতন প্রদান করা হতো।

ভারতের স্বাধীনতার পর গ্রামে মোড়লী প্রথা বন্ধ করে দেয়া হয়। যা মিজো উপজাতির প্রধানরা মেনে নেয়নি। এর পাল্টা হিসেবে ১৯৬৬ সালে লালডেঙ্গার নেতৃত্বে ভারতের থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করেছিল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট। সেই সময় আন্দোলনে যোগ দিয়ে আত্মগোপন করেন তরুণ জোরামথাঙ্গা। শুরু হয় তার জঙ্গল জীবন।

২০ বছর পরে ১৯৮৬ সালে ভারত সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পন্ন করে এমএনএফ। গঠিত হয় নতুন রাজ্য মিজোরাম। ১৯৮৭ সালে নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হন লালডেঙ্গা। সেই মন্ত্রিসভায় অর্থ ও শিক্ষাদপ্তরের দায়িত্বভার পেয়েছিলেন জোরামথাঙ্গা।

১৯৯০ সালে মারা যান লালডেঙ্গা। তারপরেই জোরামাথাঙ্গা এমএনএফ-এর প্রধান হন। ১৯৯৮ সালের নির্বাচনে জোরামের নেতৃত্বেই ক্ষমতায় আসে এমএনএফ। পরের নির্বাচনেও ক্ষমতায় ছিল এমএনএফ। পরপর দু’বার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে উত্তর-পূর্বের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বর তকমা পেয়ে যান একসময়ের জঙ্গি নেতা।

মিজোরামের উত্তর-পূর্ব ভারত একটি স্থলবেষ্টিত রাজ্য যার দক্ষিণাংশে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের প্রায় ৭২২ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমানা রয়েছে, এবং উত্তরাংশের সীমানায় মণিপুর, আসাম ও ত্রিপুরা অবস্থিত। এটি ২১.০৮৭ কিমি (৮,১৪২ বর্গ মাইল) বিশিষ্ট ভারতের পঞ্চম ক্ষুদ্রতম রাজ্য। এটি ২১°৫৬' উত্তর থেকে ২৪°৩১' উত্তর, এবং ৯২°১৬' পূর্ব থেকে ৯৩°২৬' পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। কর্কটক্রান্তি প্রায় এ রাজ্যের মাঝখান দিয়ে সঞ্চালিত হয়েছে। সর্বাধিক উত্তর-দক্ষিণ দূরত্ব ২৮৫ কিমি, এবং সর্বোচ্চ পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত ১১৫ কিমি. পর্যন্ত।

পাহাড়, হ্রদ ও নদীর দেশ মিজোরাম। সারা রাজ্যে প্রায় ২১টি বড় বড় পাহাড়শ্রেণী ও বিভিন্ন উচ্চতার চূড়া রয়েছে এবং বিভিন্ন পাহাড়শ্রেণীর ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মধ্যে দু’এক ফালি সমতল জমিরও দেখা পাওয়া যায়। পশ্চিম দিকের পাহাড়গুলোর গড় উচ্চতা প্রায় ১০০০ মিটার যা পূর্ব দিকে ক্রমশঃ ১৩০০ মিটার পর্যন্ত উঠে গেছে। কোন কোন অঞ্চলে আরও উঁচু পাহাড়শ্রেণী রয়েছে যেগুলো উচ্চতায় ২০০০ মিটারেরও বেশি। রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ফয়াংপুয়ী ট্লাং বা নীল পর্বত। এর উচ্চতা ২,২১০ মিটার। এটি মিজোরামের সর্বোচ্চ চূড়া।

মিজোরামের হালকা জলবায়ু বিরাজমান, গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ২০ থেকে ২৯° সে (৬৮ থেকে ৮৪° ফা) থাকে, এবং শীতকালে তাপমাত্রা পরিসীমা থেকে ৭ থেকে ২২°সে (৪৫ থেকে ৭২° ফা) তাপমাত্রা। এই অঞ্চল মৌসুমী বায়ু দ্বারা প্রভাবিত, শুষ্ক (ঠান্ডা) মৌসুমে সামান্য বর্ষণের পাশাপাশি মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারী বর্ষণ হয়ে থাকে।

স্বাধীনতা পরবর্তী কালে মিজোরাম আসামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৭২ এ আসাম পুনর্গঠনে মিজোরাম কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়। শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ১৯৮৬ সালে এটি পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায়। রাজ্য মর্যাদার পর বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ২২ বছর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এই রাজ্যের ক্ষমতায় থাকে। লাল থানহাওলা এখানকার অন্যতম নেতা।

এটি মায়ানমার ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী হওয়ায় এখানে কিছু সামরিক পরিকাঠামো রয়েছে যা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অংশ। খ্রিস্টান অধ্যুষিত ভৈরেংতে তে সামরিক প্রশিক্ষণ হয়। সম্প্রতি ভারত -জাপান এখানে যৌথ মহড়া করে।

এই রাজ্য প্রতি বর্গ কিমিতে ভারতের তৃতীয় জনবিরল রাজ্য। এখানে মাত্র ৫৯ জন চিকিৎসক রয়েছেন যা ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে সর্বনিম্ন।

মিজোরামের রাষ্ট্রভাষা এবং মৌখিক পারস্পরিক ক্রিয়ার জন্য সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত ভাষা হল মিজো, কিন্তু শিক্ষা, প্রশাসন, আনুষ্ঠানিকতা এবং র্রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য ব্যাপকভাবে ইংরেজি ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও লুশাই নামে পরিচিত, দুহলিয়ান উপভাষা ছিল মিজোরামের প্রথম ভাষা যা মিজো ভাষা হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। হ্মার, মারা, লাই, পেইত, গাঙতে ইত্যাদি উপভাষায় সাথেও এই ভাষা মিশ্রিন ঘটেছে। খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের মিজো লিপি উন্নত করে। রোমান লিপির সংমিশ্রণে এবং একটি ধ্বনিবিজ্ঞান-ভিত্তিক বানান পদ্ধতি বিশিষ্ট ট্রেসের সাথে হান্তরিয়ান লিপ্যন্তর পদ্ধতিতে এই ভাষার লিখন পদ্ধতি গড়ে ওঠে।

মিজো বর্ণমালার ২৫টি অক্ষর রয়েছে: A, AW, B, CH, D, E, F, G, NG, H, I, J, K, L, M, N, O, P, R, S, T, Ṭ, U, V, Z। মিজো ভারতের রাষ্ট্রভাষাসমূহের (রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে) মধ্যে একটি। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত হিন্দি সকল শিক্ষার্থীদের জন্য আবশ্যিক বিষয় এবং এখানে এর ক্রমবর্ধমান ব্যবহার রয়েছে। এছাড়াও রাজ্যের নেপালি অভিবাসী কর্তৃক নেপালি ভাষা ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

২০১১ সালের আদমশুমারী অনুসারে মিজোরামের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ (৮৭%) মিজো খৃস্টান ধর্মালম্বী যারা প্রধানত প্রেসবিটারিয়ান, বাকি জনসংখ্যার ৮.৩% বৌদ্ধ, ৩.৬% হিন্দু ধর্মালম্বী। কয়েক হাজার মানুষ রয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নৃতাত্ত্বিক মিজো, যারা ইহুদি ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ১.১% মুসলিম। মিজোরামে বেশিরভাগ মুসলমান জাতিগতভাবে রোহিঙ্গা। অবশিষ্ট ৩,০০০ মানুষ শিখ, জৈন এবং অন্যান্য ধর্মালম্বী।

মিজোরাম প্রেসবিটারিয়ান গীর্জার প্রধান খ্রিস্টান সম্প্রদায়, যা একজন ওয়েলশ ধর্মপ্রচারক রেভারেন্ড ডি.ই. জোন্স কর্তৃক ১৮৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সময়, লুশাই আদিবাসী জাতির ৮০% খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়।

২০০১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদন অনুযায়ী মিজোরামের জনসংখ্যার প্রায় ৭০.৪৯৪ জন মানুষ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। ২০০১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদন অনুযায়ী মিজোরামের প্রায় ৩১.৫৬২ জন হিন্দু ধর্মের অনুসারী, যা মোট জনসংখ্যার শতকারা ৩.৫৫%।

এছাড়াও মিজোরামের কিছু সংখ্যক মানুষ ইহুদি ধর্ম অনুশীলন করে থাকে, ২০০১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদন অনুযায়ী তাদের সংখ্যা প্রায় ৮৬৬ জন।

দেশের বাকি রাজ্যকে পিছনে ফেলে হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস বা এইচআইভি প্রসারে শীর্ষে উঠে এসছে মিজোরাম।

মিজোরাম স্টেট এইডস কন্ট্রোল সোসাইটির(এমএসএসিএস) আর একটি রিপোর্ট থেকে রাজ্যে রোজ গড়ে ৯ জনের রক্তপরীক্ষায় এইচআইভি পজিটিভ ধরা পড়ছে। এইচআইভি ভাইরাস সংক্রমণ প্রবণতা যে রাজ্যগুলিতে সব থেকে বেশি, সেই তালিকায় মিজোরাম শীর্ষ স্থানে রয়েছে (২.৪ শতাংশ)। রাজ্যের আইজল-এ একটি ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রযুক্তিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

মিজোদের তিনটি বড় উৎসব রয়েছে: মিম কুট,ছাপচার কুট,পাউল কুট। এ তিনটি উৎসব কোন না কোন ভাবে কৃষিকর্মের সাথে সম্পৃক্ত।

মিম কুট: এ উৎসবটি সাধারণত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ভুট্টা ফসল ঘরে তোলার সময় অনুষ্ঠিত হয়। মৃত আত্মীয়-স্বজনদের স্মরণে উৎসর্গীকৃত এ উৎসবটির মূলে রয়েছে কালের স্মরণ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের চেতনা। মৃতদের স্মরণে তৈরী একটি উঁচু মাচানের উপর প্রথম ফসল উৎসর্গ করা হয়।

ছাপচার কুট: বসন্তকালে জুম কাটা শেষ হলে এ উৎসবটি পালন করা হয়। মিজোদের সব চাইতে আনন্দময় উৎসব এটি। ঋতুটিও খুবই উপযোগী। বসন্ত ঋতুকে জায়গা করে দিয়ে শীত ধীরে ধীরে বিদায় নেয়। এ সময় প্রকৃতি পুনরুজ্জীবন লাভ করে ও মানুষের জীবনে সজীবতা বয়ে নিয়ে আসে। বয়স ও লিঙ্গ ভেদে মিজোরা এ উৎসবে অংশ গ্রহণ করে। বর্ণিল পোশাকে সজ্জিত হয়ে ছেলেমেয়েরা নাচের উৎসবে মেতে উঠে যা অনেক সময় সারা রাত ধরে চলতে থাকে।

পাউল কুট: ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ফসল কাটার পরে এ উৎসবটি উদ্যাপিত হয়। এখানেও ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দেয় কারণ জমি কর্ষণ ও ফসল কাটার মত কঠিন কাজটি এখন শেষ হয়েছে। সমবেত ভুরি ভোজন ও নাচের আয়োজন হয়। স্মারক মাচানের উপর মায়েরা বসে তাদের শিশু সন্তানদের খাওয়ায়। ঈযধঢ়পযধৎ কঁঃ উৎসব উদ্যাপনকালে যে সামাজিক প্রথাটি পালন করা হয় তা ঈযযধহিমযহধঃি নামে পরিচিত। তঁভধহম বা ধেনো মদ পানও এ উৎসবের একটি অংশ। দু’দিন ধরে উদ্যাপিত এ উৎসবের পরের পুরো একটি দিন বিশ্রামের দিন। এ দিন কেউই কাজে বেরোয় না।

মনোরম পরিবেশ ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ মিজোরা জাতি হিসেবে প্রাণবন্ত ও অত্যন্ত মিশুক। গান করতে যেমন, নাচতেও মিজোরা ভালবাসে। তারা এমন কিছু লোকজ ও সমবেত নৃত্যের জন্য গর্ব করতে পারে যা তারা কালের ধারায় বংশানুক্রমে ধারণ করে আসছে। মিজোদের নাচগুলো তাদের উচ্ছল ও নিরুদ্বেগ প্রাণসত্তার প্রকাশ । এটি এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, মিজোদের নাচগুলো মঞ্চের উপর অনুষ্ঠানযোগ্য কোন কর্ম নয়। এটি তারা স্বভাবগত ভাবে বিকশিত করেছে সমবেত ভাবে সম্পৃক্ত হ’তে ও অংশগ্রহণ করতে।

মিজো নাচের মধ্যে সবচেয়ে বর্ণিল এ ঈযবৎধি নৃত্য। এ নাচে বাঁশ ব্যবহার করা হয়। বাঁশগুলো ঠুকলে যে শব্দ বেরোয়, সেই শব্দই এ নাচের তাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নৃত্যশিল্পীরা সমান্তরাল একজোড়া বাঁশের মধ্যে পরিবর্তন সাপেক্ষে একবার লাফিয়ে ঢুকে আবার বোরয়ে এসে এবং জোড়া বাঁশের একদিক থেকে অন্যদিকে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচ করতে থাকে। কিছু ব্যক্তি উভয় পার্শ্বে মুখোমুখি বসে বাঁশগুলোকে মাটি বরাবর ধরে রাখে। ছন্দোময় তালে তারা বাঁশগুলোকে ঠুকে পর্যায়ক্রমে একবার ফাঁক ও একবার সংযুক্ত কারে। এটি নাচের গতিকেও নির্দেশ করে।

এ নাচে পা ফেলা ও তার ধরনের মধ্যে বিভিন্নতা রয়েছে এবং তা অঞ্চলভেদে ভিন্নও। আজকাল চিরাউ (ঈযবৎধ) নাচটি যে কোন সময়ে করা হয়। কিন্তু আগেকার দিনে সন্তান প্রসবের সময় মরে যাওয়া মায়ের আত্মার নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করার জন্য এ নাচ করা হতো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশে ঈযবৎধ-িএর অনুরূপ তাদের নিজস্ব বাঁশনৃত্য রয়েছে। মিজোরাম, ২০১০ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত ঈযধঢ়পযধৎ কঁঃ উৎসবের সময় ১০ হাজার নৃত্যশিল্পীর অংশগ্রহণে ঈযবৎধি নাচের অনুষ্ঠানটি করে বৃহত্তম গণ-বাঁশ নৃত্য হিসেবে ‘‘গিনেস বুক’’-এর রেকর্ডে স্থান করে নিয়েছে।

মিজোদের মধ্য বর্তমানে খ্রিস্টানিটি চালু হলেও এখনো তাদের নিজস্ব প্রথাগত আইনও বহাল আছে। মিশনারীরা মিজোদের নিজস্ব প্রথাগুলি পরিবর্তনের জন্য কোন প্রকার চাপ প্রয়োগ করে না। তবে যে সব প্রথা এবং ঐতিহ্য অর্থহীন বা ক্ষতিকর সেগুলি ধর্মদেশনার বা প্রচারণার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করা হয়েছে। এভাবেই চা খাওয়ার পরিবর্তে ুঁ নামে এক জাতীয় পানীয় পানের অভ্যাস গড়ে তুলেছে মিজোরা। পশু হত্যার উৎসবও এখন ত্যাগ করেছে মিজোরা। তবে কনে পণ দেওয়ার রীতিটি বহাল রয়ে গেছে।

বর কর্তৃক কনেকে পণ দেওয়া হচ্ছে মিজো সম্প্রদায়ের বিবাহ রীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তবে কনে পণের বিভিন্ন নিয়ম নীতি আছে।

মিজো বিবাহ সম্পন্ন হয় আইনগত প্রক্রিয়ায় ও আশীর্বাদ প্রথার নিয়মে। তবে ছেলে এবং মেয়ে আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়ে মুক্ত ভাবে মেলামেশা করতে পারে। যদি দুজনের মধ্যে মনের মিল না হয় তাহলে আশীর্বাদ ভেঙে যেতে পারে। মিজোদের বিবাহ সাধারণত গীর্জাতেই হয়ে থাকে। আধুনিক ও পশ্চিমা স্টাইলে মিজোরা বিবাহ পোশাক পরিধান করে থাকে। কিন্তু মাঝে মাঝে কনেরা মিজোদের প্রথাগত পোশাক ‘‘পঞ্চেই’’ এবং সাদা ব্লাউজ পড়ে। সাধারণত কনেকে বরের ঘরে নিয়ে আসার সময় প্রথাগত একটি আচ্ছাদন দেওয়া হয়। যার নাম চঁধহফঁস। যেটি দিয়ে মৃত্যুর পর আবার তাকে সমাহিত করা হয়।

সাধারণত মিজো পুরুষরাই সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়। তবে পারিবারিক সম্পত্তি পরিবারের ছোট ছেলেই পেয়ে থাকে। যদিও পিতা ইচ্ছে করলে অন্যান্য সন্তানদেরকেও সম্পদের ভাগ দিতে পারে। কারো সন্তান না থাকলে পুরুষ পক্ষের নিকট আত্মীয়রা সম্পদের উত্তরাধিকারী হবে। কেউ মারা গেলে তার বিধবা স্ত্রী ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের দায়িত্ব ভাই সম্পর্কীয় কোন আত্মীয় নিতে পারে। তিনি পরিবার এবং সম্পদের দেখাশুনা করবেন। অন্তত একজন সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করে থাকে।

যদি কাছের পুরুষ আত্মীয় না থাকে, তখন বিধবাটি তার স্বামীর ট্রাস্টি হিসেবে গণ্য হবেন ছেলে উপযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত। মিজোদের প্রথাগত নিয়মে পরিবারের ছোট সন্তান সম্পদের উত্তরাধিকারী হলেও ব্স্তাবে বর্তমানে মিজো সম্প্রদায়ে সকল সন্তানকে সম্পদ ভাগ করে দেওয়ার রীতি প্রচলিত হয়েছে। তথাপি ছোট সন্তানের অগ্রাধিকার রয়ে গেছে, কারণ এক্ষেত্রে ছোট সন্তানকে ভাগের দুই অংশ দেওয়া হয়। যিনি মারা যান, তার যদি কোন পুরুষ আত্মীয় স্বজন না থাকে তখন মৃত ব্যক্তি স্ত্রী ও কন্যা সম্পদের উত্তরাধিকারী হতে পারে।

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে ভারতের অন্যান্য অংশের সঙ্গে এই রাজ্যের তেমন পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি।বর্তমানে ভারতীয় রেল বৈরাবি শহর পর্যন্ত রেলপথ বিস্তার করেছে। ২০২০ সালের মধ্যে তা রাজ্যের রাজধানী আইজল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে।

রাজ্যের একমাত্র বিমানবন্দর হচ্ছে ২.৫ কিমি দীর্ঘ রানওয়ে বিশিষ্ট লেংপুই বিমানবন্দর। আকাশপথে আইজল-এর সাথে কলকাতা ও দিল্লী শহরের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে।

নিউজজি/ এস দত্ত

 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন