রবিবার, ৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ কার্তিক ১৪৩১ , ১ জুমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার
  >
মানচিত্র

হযরত বেলালের দেশ ইথিওপিয়া

নিউজজি ডেস্ক ২৭ জুন , ২০২১, ১৫:৫৫:০২

3K
  • হযরত বেলালের দেশ ইথিওপিয়া

ঢাকা: আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া। এর উত্তর ও উত্তর-পূর্বে ইরিত্রিয়া, পূর্বে জিবুতি ও সোমালিয়া, পশ্চিমে সুদান ও দক্ষিণে কেনিয়া। আদ্দিস আবাবা দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। ভূমিবেষ্টিত এই দেশটি আফ্রিকার দ্বিতীয় ঘনবসতিপূর্ণ দেশ।

ইথিওপিয়ার ইতিহাস বেশ পুরনো।জানা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো গীর্জাগুলোর একটির অবস্থান ইথিওপিয়ায়। বিংশ শতাব্দী পর্যন্তও দেশটি আবিসিনিয়া নামে পরিচিত ছিল। ইথিওপিয়া আফ্রিকার প্রাচীনতম স্বাধীন রাষ্ট্র। প্রথম শতাব্দীতে এখানে আকসুম নামের একটি শক্তিশালী খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের পত্তন হয়। ১৬শ শতকের পরে ইথিওপিয়া অনেকগুলি ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। ১৮৮০-র দশকে রাজা ২য় মেনেলিক-এর অধীনে এগুলি পুনরায় একত্রিত হয়। ১৯৫০-এর দশক থেকে ইরিত্রিয়া ইথিওপিয়ার একটি অংশ ছিল, কিন্তু ১৯৯৩ সালে এটি বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে।

ধারণা করা হয়, আধুনিক মানুষের প্রথম বাস ছিল ইথিওপিয়ায়। পরে তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে ইথিওপিয়া ছিল রাজা শাসিত। বহুভাষী মানুষের দেশ ইথিওপিয়াই হচ্ছে আফ্রিকার একমাত্র দেশ, যারা বিংশ শতাব্দীতে জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পরই এর সদস্যপদ লাভ করে দেশটি।

নারীর প্রতি সহিংসতায় অন্যতম এই দেশটি। জাতিসংঘের একটি জরিপে উঠে এসেছে যে এ দেশের প্রায় ৬০ ভাগ নারী যৌন সহিংসতার শিকার। ধর্ষণ খুবই গুরুতর একটি সমস্যার আকার নিয়েছে সেখানে। অপহরণ করে বিয়ে করার কারণে ইথিওপিয়া কুখ্যাত এবং এই ব্যাপারটি সেদেশেই সবচাইতে বেশি হয়।

সেখানে অনেক জায়গায়ই পুরুষরা বন্ধুবান্ধব নিয়ে কোনো মেয়ে বা মহিলাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং তারা ঘোড়া ব্যবহার করাতে পালাতে সুবিধা হয়। ইথিওপিয়ায় এটা খুব সাধারণ ঘটনা। অপহরণকারী এরপর তার কনেকে ধর্ষণ করে চলে যতদিন না সে অন্তঃসত্ত্বা হয়। ১১ বছরের কন্যাশিশুও ছাড়া পায় না তাদের হাত থেকে। এছাড়া ইথিওপিয়ার মিলিটারিরাও এই অপরাধে অভিযুক্ত।

তবে দেশের সার্বিক উন্নতির সাথে সাথে পাল্টে যাচ্ছে রাজধানী আদ্দিস আবাবাও। আকাশচুম্বী আধুনিক অট্টালিকা, উন্নত রেল যোগাযোগ ও সুন্দর, ঝকঝকে তকতকে রাস্তাঘাট সবই গড়ে উঠেছে সেখানে। চীনের বিনিয়োগে বদলে যাচ্ছে ইথিওপিয়া, বদলে যাচ্ছে আদ্দিস আবাবা। সমুদ্র স্তর থেকে প্রায় ২ হাজার ৩৫৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত শহরটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু রাজধানীগুলোর একটা। ৩০ লক্ষাধিক নাগরিকের বাস এই শহরে। আদ্দিস আবাবার এক প্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে পলি লোটাস এস্টেট নামে বিশাল এক অট্টালিকা। এটা তৈরি করেছে চীনের এক বেসরকারি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান শিহাই রিয়েল এস্টেট।

এমন শহরজুড়ে শত শত অট্টালিকা নির্মাণ করেছে চীনা কোম্পানি এবং তা অব্যাহত আছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিক বিমানবন্দর, শহরের মধ্য দিয়ে আধুনিক রেলপথ, রাস্তাঘাট। এর সবই তৈরি হয়েছে চীনা বিনিয়োগে। সব মিলিয়ে আদ্দিস আবাবা দেখতে পুরো দস্তুর চীনের আর পাঁচটা শহরের মতোই।

১৯৯৫ সালে চীন সফর করেন সাবেক ইথিওপীয় প্রধানমন্ত্রী মেলেস জেনাউই, যেখানে দু’পক্ষ স্বাক্ষর করেছিল একটি অর্থনৈতিক চুক্তিতে। ২০০০ সালে চীন-আফিকা সহযোগিতা বিষয়ক থম সম্মেলন আয়োজন করে বেইজিং। এরপর ২০০৩ সালে আদ্দিস আবাবা দ্বিতীয় সম্মেলন আয়োজন করায় দু’দেশের সম্পর্ক আরো জোরদার হয়। আদ্দিস আবাবার ভাগ্য বদলের সেই শুরু।

গত দুই দশকে চীন আদ্দিস আবাবায় ৮ কোটি ৬০ লাখ ডলারের রাস্তাঘাট, ১ কোটি ২৭ লাখ ডলারের গোরেটা ক্রসরোড, ৮০ কোটি ডলার ব্যয়ে ইথিওপিয়ার প্রথম ছয় লেনের হাইওয়ে, ৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ইথিও-জিবুতি রেলওয়ে নির্মাণ করে।এখানেই চীন নির্মাণ করেছে সাব-সাহারা অঞ্চলের প্রথম মেট্রোরেল সিস্টেম। এটা ঘণ্টায় ৩০ হাজার যাত্রীকে বহন করতে সক্ষম। একই সাথে চলে আবাসন খাত, শিল্প খাত ইত্যাদিতে ব্যাপক বিনিয়োগ।

কালো ইথিওপিয়ায়ও ঢেলে দিয়েছে সৌন্দর্যের ডালি। আগ্নেয়গিরির লাভায় গড়ে তুলেছে রঙিন পাহাড়। পাহাড় নয়, যেন রঙিন ফুল। দেশটির গ্রেট রিফ অঞ্চলে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে। সেখান থেকে প্রায়ই লাভাস্রোত প্রবাহিত হয়ে নিম্নাঞ্চলকে প্লাবিত করে। এমনই আরও বহু বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যে ভরা দেশটি।

উত্তর ইথিওপিয়ায় পর্যটকরা খুব কমই পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলে ভ্রমণ করে, হারারে প্রাচীন প্রাচীরঘেরা অতি পুরানো একটি শহর । এটি ‘পবিত্রতম শহর’ হিসেবে পরিচিত। এখানে ৮২ টি মসজিদ আছে, পাশাপাশি ইথিওপিয়ার সেরা বিয়ার, সর্বব্যাপী মাদকদ্রব্য উদ্ভিদ এবং বিশ্ব মানের কফি পাওয়া যায়।

যখন রাত্রি নামে তখন শহরে হায়েনার দল নেমে আসে। হায়েনা শিকারি জীব হিসেবে পরিচিত, তাদের কামড় নাকি বাঘ-সিংহের চেয়েও বেশি জোরালো৷ কিন্তু এই শহরের বাসিন্দারা প্রাচীনকাল থেকেই বংশপরম্পরায় রাতের বেলা বুনো হায়েনাদের খাবার খাওয়ায়। ইথিওপিয়ার হারার শহরে মানুষজন বুনো হায়নার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছেন৷

ইসলামের ইতিহাসে ইথিওপিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিমদের উপর যখন কুরাইশদের নির্যাতন কঠোর থেকে কঠোরতর হতে লাগল এবং তাদেরকে যখন বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি দেয়া শুরু করল তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের উপর দয়া করলেন এবং মুশরিকদের নির্যাতন হতে মুক্তি দান কল্পে আবিসিনিয়ায় হিজরত করার অনুমতি দিলেন।

আবিসিনিয়ার বাদশাহ্ নাজাশী ছিলেন একজন ন্যায় পরায়ণ ও দয়ালু বাদশাহ। তাদের দলনেতা ছিলেন উসমান বিন আফ্ফান (রাঃ)। তাঁর সাথে ছিলেন নাবী নন্দিনী রুকাইয়্যা (রাঃ)। তারা ছিলেন সংখ্যায় ১২জন পুরুষ ও ৪জন মহিলা। তারা গোপনে মক্কা থেকে বের হলেন।

লোহিত সাগরের তীরে গিয়ে আল্লাহর তাওফীক মোতাবেক তারা দু’টি নৌকা পেয়ে গেলেন। নৌকার মাঝিরা তাদেরকে উঠিয়ে নিলেন। এটি ছিল নবুওয়াতের ৫ম সনের রজব মাসের ঘটনা। কুরাইশরা তাদের সন্ধানে বের হয়ে সাগরের তীর পর্যন্ত পৌঁছল। কিন্তু তারা তাদের সন্ধান পেলনা। তারা আবিসিনিয়ায় পৌঁছে উত্তমভাবে অবস্থান করতে শুরু করলেন। এদিকে আবিসিনিয়ায় মুহাজিরদের নিকট এই মর্মে খবর পৌছে যায় যে, কুরাইশরা মুসলিমদের উপর নির্যাতন বন্ধ করেছে এবং তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে।

সুতরাং তারা ঐ বছরের শাওয়াল মাসে প্রত্যাবর্তন করেন। যখন তারা মক্কায় এসে পৌঁছেন তখনই আসল তথ্য অবগত হতে সক্ষম হন। তারা জানতে পারেন যে, কুরাইশরা আগের চেয়ে আরও বেশী নির্যাতন চালাচ্ছে। তখন তাদের কেউ কেউ পুনরায় আবিসিনিয়া ফেরত চলে যায় আবার কেউ কেউ গোপনে অথবা কুরাইশদের কারো নিরাপত্তায় মক্কায় প্রবেশ করেন।  

সোয়া চৌদ্দশ বছর আগের একটি ঘটনা। আরব মরুভূমির মধ্যাহ্ন। আগুনের মতো রোদ নামছে আকাশ থেকে। মরুভূমির বালু যেন টগবগিয়ে ফুটছে। উমাইয়া তার ক্রীতদাসকে নির্দয়ভাবে প্রহার করল। তারপর তাকে সূর্যমুখী করে শুইয়ে দেয়া হলো। ভারি পাথর চাপিয়ে দেয়া হলো তার বুকে। ক্রীতদাসের মুখে কোনো অনুনয়-বিনয় নেই। মনে নেই কোনো শঙ্কা। চোখে কোনো অশ্রু নেই, মুখে কোনো আর্তনাদও নেই। ঊর্ধ্বমুখী তাঁর প্রসন্ন মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে আল্লাহর প্রশংসা ধ্বনি ‘আহাদ’, ‘আহাদ’। ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ শব্দ তার কানে গেল।

অনুসন্ধিৎসু হয়ে শব্দ লক্ষ্য করে তিনি মরুভূমির বুকে শায়িত ক্রীতদাসের কাছে গেলেন। উমাইয়াকে দেখে সব ব্যাপারই তিনি মনে মনে বুঝে নিলেন। বললেন, ‘উমাইয়া, আপনাকে তো ধনী ও বিবেচক লোক বলেই জানতাম। কিন্তু আজ প্রমাণ পেলাম, আমার ধারণা ঠিক নয়। দাসটি যদি এতোই অপছন্দ, তাকে বিক্রি করে দিলেই পারেন। এমন নির্দয় আচরণ কি মানুষের কাজ?’ হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এর ওষুধে কাজ হলো।

উমাইয়া বলল, ‘এতো বাহাদুরি দেখাবেন না। দাস আমার, এর ওপর সদাচার-কদাচার করার অধিকার আমারই। তা যদি এতোই দয়া লেগে থাকে, তবে একে কিনে নিলেই পারেন!’ হজরত আবু বকর (রা.) এ সুযোগেরই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি চট করে রাজি হয়ে গেলেন। একজন শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস ও দশটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে কিনে নিলেন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসকে। হজরত আবু বকর (রা.) মরুভূমির বুক থেকে টেনে তুলে সেই দাসের মাথা থেকে ধুলো ঝেড়ে দিলেন।

উমাইয়া বিদ্রূপের হাসি হেসে বলল, ‘কেমন বোকা তুমি বলো তো? এ অকর্মণ্য ভৃত্যটাকে একটি স্বর্ণ মুদ্রার বিনিময়েই বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলাম। এখন আমার লাভ ও তোমার ক্ষতি দেখে হাসি সংবরণ করতে পারছি না।’ আবু বকরও হেসে বললেন, ‘আমি ঠকিনি বন্ধু! এ ক্রীতদাসকে কেনার জন্য আমার সব সম্পত্তি দিতে হলেও আমি কুণ্ঠিত হতাম না। কিন্তু একে আমি ধারণাতীত সস্তা মূল্যে ক্রয় করে নিয়ে চললাম।’ এ দাসটিই ছিলেন বিশ্ব-বিশ্রুত সাহাবি হজরত বেলাল ইবনে রাবাহ (রা.)। ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন।  এ মহান সাহাবির দেশ ইথিওপিয়া। 

এক নজরে ইথিওপিয়া

সরকারি নাম: ফেডারেল ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব ইথিওপিয়া।

রাজধানী: আদ্দিস আবাবা।

সরকার পদ্ধতি: ফেডারেল পার্লামেন্টারি রিপাবলিক।

আইনসভা: উচ্চ কক্ষ: হাউজ অব ফেডারেশন।

নিম্নকক্ষ: হাউজ অব পিপলস রিপ্রেজেন্টেটিভস।

আয়তন: ১১ লাখ ৪ হাজার তিনশ বর্গকিলোমিটার।

জনসংখ্যা: ১০ কোটি ২৪ লাখ ৩ হাজার ১৯৬ জন ।

ঘনত্ব: প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯২.৭ জন।

মাথাপিছু জিডিপি: ১ হাজার ৮৬৯ ডলার।

মুদ্রা: বির।

ভাষা: আমহারি।

জাতিসংঘে যোগদান: ১৩ নভেম্বর, ১৯৪৫ সালে।

ছবি ও তথ্য – ইন্টারনেট 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন