শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২ , ২০ শাওয়াল ১৪৪৬

ফিচার
  >
ব্যক্তিত্ব

কমরেড ফয়েজ আহমদের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

নিউজজি ডেস্ক ২০ ফেব্রুয়ারি , ২০২৫, ১৫:২২:১৩

125
  • কমরেড ফয়েজ আহমদের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

ঢাকা: কমরেড ফয়েজ আহমদ ১৯২৮ সালের ২ মে বিক্রমপুরের বাসাইলডোগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গোলাম মোস্তফা চৌধুরী, মা আরজুদা বানু। ছোটবেলায়ই তাকে দেশ ভাগ, ৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলন এবং ৪২-৪৩ এর মন্বন্তর বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। তখন থেকেই ভেতরে ভেতরে তিনি যেন একটি ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ হয়ে উঠেছিলেন, তাকে ব্যতিক্রমী চরিত্র করে তোলে।

কিশোর বয়সেই কমরেড ফয়েজ আহমেদ কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ১৯৬০ সালে জেলে থাকা অবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। আমৃত্যু তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সদস্য ছিলেন। পার্টির নির্দেশে তিনি ১৯৫৪ সালে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্টদের সহায়তায় ‘করিম শাহানী’ ছদ্মনাম নিয়ে বিনা পাসপোর্টে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক যুব সম্মেলনে যোগ দেন। এজন্য তাকে ‘হিরো’ বলা হতো।

পাকিস্তান আমলে তিনি ১৯৫৯ সাল থেকে ৪ বছর কারাবন্দি ছিলেন। হাইকোর্ট গঠিত বোর্ডের মাধ্যমে মুক্তি পেলেও, জেলগেটেই এক বছরের জন্য তার ঢাকা শহরের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয় এবং রমনা থানা এলাকায় নজরবন্দি করে রাখা হয়। স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলেও তিনি কারাভোগ করেছেন। রাজনৈতিক কারণে তাকে ৩ বার দীর্ঘ সময়ের জন্য আত্মগোপন করতে হয়েছে। তার নামে হুলিয়াও ছিল।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে রাত ১১টায় তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবে আশ্রয় নেন। সেখানেই তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের শিকার হন। ভোরে ট্যাঙ্ক দিয়ে পাকবাহিনী তার আশ্রয় নেয়া কক্ষে গোলাবর্ষণ করলে, তিনি বাম ঊরুতে আঘাত পেয়ে মেঝেতে পড়ে যান। পরে সচিবালয়ে আশ্রয় নিয়ে জীবন বাঁচান। পরবর্তীতে আগরতলায় কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগিতায় কলকাতায় চিকিৎসা নেন।

তিনি স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করে নিয়মিত ‘পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে’ রিপোর্ট করেন। ঢাকা মুক্ত হবার সময় প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে ২২ ডিসেম্বর যে অগ্রবর্তী দলটিকে ঢাকায় পাঠানো হয়, তিনি সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন।

জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তিনি ছিলেন সেই আন্দোলনের অন্যতম নেতা। গণ-আদালতের ১১ জন বিচারকের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। পরবর্তীতে গণ-আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার জন্য যে ২৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল, তিনি ছিলেন তাঁদের একজন। স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৪৮ সাল থেকেই কমরেড ফয়েজ আহমদ সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত। যারা এই ভূ-খণ্ডে সংবাদ মাধ্যমকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন কমরেড ফয়েজ আহমদ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ‘ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’, ‘আজাদ’ ও পরবর্তীতে ‘পূর্বদেশ’-এ চিফ রিপোর্টার ছিলেন। তিনি সাপ্তাহিক ‘ইনসাফ’ ও ‘ইনসান’ পত্রিকায়ও রিপোর্টিং করেছেন। ১৯৫০ সালে ‘হুল্লোড়’ ও ১৯৭১ সালে ‘স্বরাজ’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি ‘জাতীয় সংবাদ সংস্থা’র প্রথম প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। পরে দৈনিক ‘বঙ্গবার্তা’র প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।

সাংবাদিকতা করার সময় থেকেই তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তার নেতৃত্বে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাঁর নেতৃত্বে জোটের কর্মীরা ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান।

তিনি আমৃত্যু বাংলাদেশ-কিউবা মৈত্রী সমিতি, মাস্টারদা সূর্যসেন স্মৃতি পরিষদের সভাপতি ছিলেন। ১৯৯২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকার প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ গ্যালারি ‘শিল্পাঙ্গণ’। এছাড়া প্রগতিশীল পাঠাগার ‘সমাজতান্ত্রিক আর্কাইভ’-এর তিনি প্রতিষ্ঠাতা। তার অক্লান্ত পরিশ্রম আর নেতৃত্বে ১৯৬৬ সালে পিকিং রেডিওতে বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা কেন্দ্রে ১৯৫২ থেকে ৫৪ পর্যন্ত ‘সবুজ মেলা’ নামে ছোটদের একটি বিভাগ পরিচালনা করতেন। তিনি জাতীয় কবিতা উৎসবের প্রথম ৫ বছর আহ্বায়ক ছিলেন।

এছাড়া ১৯৮২ তে বাংলা একাডেমীর কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু পরে এরশাদের সামরিক শাসনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। ৮০-র দশকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ বছর ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ বছর সিন্ডিকেটের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৪৪ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ‘শিশু সওগাত’-এ ফয়েজ আহমদের লেখা ‘নাম বিভ্রাট’ শিরোনামে একটি রচনা প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তার জীবনের প্রথম মুদ্রিত লেখা। সাহিত্যের প্রতি দুর্বার টানে ১৬ বছর বয়সে স্কুল ফাঁকি দিয়ে কলকাতার সওগাত অফিসে ছুটে যান।

দেশ বিভাগের পর ‘সওগাত’ অফিসে নাসিরুদ্দিন সাহেবের সর্বাত্মক সহযোগিতায় প্রগতি ও মুক্তবুদ্ধির ধারক হিসেবে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠিত হলে, তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। যারা প্রকাশ্যে এ সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন অজিত গুহ, মুনীর চৌধুরী, কবি শামসুর রাহমান, অধ্যাপক সারোয়ার মোর্শেদসহ অনেকেই। কয়েকজন উর্দু প্রগতিশীল কবিও এ সংসদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন।

কমরেড ফয়েজ আহমদ প্রধানত শিশু-কিশোরদের জন্য ছড়া ও কবিতা লিখেছেন। তার গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ সবচেয়ে বিখ্যাত। তিনি চীনসহ বিভিন্ন দেশের ৫টি গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন।

কমরেড ফয়েজ আহমেদ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বাংলা একাডেমি পুরস্কার, শিশু একাডেমি পুরস্কার, সাব্বির সাহিত্য পুরস্কার, নুরুল কাদের শিশু সাহিত্য ও মোদাব্বের হোসেন আরা শিশু সাহিত্য পুরস্কার। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য তিনি ১৯৯১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। তিনি ভারত, কিউবা, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে নানা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন।

৪ ভাই, ৫ বোনের মধ্যে ৫ম কমরেড ফয়েজ আহমেদ ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অকৃতদার।  ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বারডেম হাসপাতালে তার প্রয়াণ ঘটে।

নিউজজি/এস দত্ত/নাসি

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন