শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ , ১৯ রমজান ১৪৪৫

ফিচার
  >
ব্যক্তিত্ব

কবি হেলাল হাফিজ কবিতার এক বিপ্লবী ফেরিওয়ালা

নিউজজি ডেস্ক ৭ অক্টোবর , ২০২১, ১১:২৪:১৪

365
  • কবি হেলাল হাফিজ কবিতার এক বিপ্লবী ফেরিওয়ালা

ঢাকা: সময় তখন উত্তাল! রাজধানীর রাজপথে এমন কি অলি-গলিতে, জনে-জনে, মনে-মনে একটাই উচ্চারণ স্বৈরাচার নিপাত যাক। তেমনি উত্তপ্ত বিপ্লবের মুখে দুটি পঙক্তি যেন অগ্নিশিখার মত জ্বলে উঠলো। সেই আগুন অতি দ্রুততায় ছড়িয়ে পড়ল সারাদেশের মাঠে ময়দানে, পাঠক, লেখক এমনকি গণ-মানুষের মননে। 

‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়` কবিতাপ্রেমী ও সাধারণ পাঠকের মুখে উচ্চারিত এই পঙক্তিটি। সেদিনের সেই তরুণটি হয়ত ভাবতেও পারেননি এ দুটো পঙক্তি দিয়েই বাংলা সাহিত্যে তার স্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। কালক্রমে সেই তরুণ পরিণত হলেন ষাটের দশকের একজন প্রধান কবি হিসেবে।

হ্যাঁ, দ্রোহ, বিপ্লব আর ভালোবাসার কবি হেলাল হাফিজের কথাই বলছি। আজ ৭ অক্টোবর প্রিয় এই কবির ৭৪তম জন্মদিন। ১৯৪৮ সালের এই দিনে প্রতিভাবান কবি হেলাল হাফিজ নেত্রকোনায় জন্ম নেন। তার বাবা খোরশেদ আলী তালুকদার আর মা কোকিলা বেগম। নেত্রকোনা শহরেই কেটেছে কবির শৈশব, কৈশোর ও প্রথম যৌবন। শৈশবে মাকে হারানো হেলাল হাফিজ আশ্চর্য এক বেদনাবোধ নিয়ে বেড়ে উঠেছেন। এই বেদনাবোধ থেকেই হয়ত তার মাঝে কবিতার জন্ম।

১৯৬৫ সালে নেত্রকোনা থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে এইচএসসি পাস করে ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান হেলাল হাফিজ। সে রাতে ফজলুল হক হলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় পড়ে সেখানেই থেকে যান। রাতে নিজের হল ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক) থাকার কথা ছিল। সেখানে থাকলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার হতেন। 

২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়ার পর ইকবাল হলে গিয়ে দেখেন চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, লাশ আর লাশ। হলের গেট দিয়ে বেরুতেই কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে দেখা। তাকে জীবিত দেখে উচ্ছ্বসিত আবেগে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন নির্মলেন্দু গুণ। ক্র্যাকডাউনে হেলাল হাফিজের কী পরিণতি ঘটেছে তা জানার জন্য সে দিন আজিমপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন কবি গুণ। পরে নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জের দিকে আশ্রয়ের জন্য দুজনে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক পূর্বদেশে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক, ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি দৈনিক দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন। 

হেলাল হাফিজ বাংলাদেশের এমন একজন আধুনিক কবি যিনি স্বল্পপ্রজ হলেও বিংশ শতাব্দীর শেষাংশে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি কষ্ট ফেরি করেন। যার কাছে রয়েছে হরেক রকম কষ্ট। আসলেই কী কষ্ট? নাকি তিনি ফেরি করেন এক বুক ভালোবাসা? আশ্চর্য রকম সব কবিতা তার। বাংলা কবিতার ইতিহাসে হেলাল হাফিজ তাই ভালোবাসা এবং কবিতার আশ্চর্য এক ফেরিওয়ালা।

১৭ বছর লেখালেখির পর ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় হেলাল হাফিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বাধিক বিক্রীত এই কাব্যগ্রন্থ হেলাল হাফিজকে এনে দেয় কবি খ্যাতি আর ব্যাপক জনপ্রিয়তা। প্রকাশ হওয়ার পর ১২টি সংস্করণ হয়েছে এই কাব্যগ্রন্থের। ২৬ বছর পর ২০১২ সালে আসে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ `কবিতা একাত্তর`। কবি হেলাল হাফিজের অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা `নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়`। 

তার রচিত কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়, নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল, দুঃসময়ে আমার যৌবন, অস্ত্র সমর্পণ, অগ্নুৎসব, বেদনা বোনের মতো, ইচ্ছে ছিলো, প্রতিমা, অন্যরকম সংসার, নিখুঁত স্ট্রাটেজি, আমার সকল আয়োজন, অনির্ণীত নারী, অশ্লীল সভ্যতা, কবিতার কসম খেলাম, পরানের পাখি, বাম হাত তোমাকে দিলাম, উপসংহার, হিরণবালা, দুঃখের আরেক নাম, প্রত্যাবর্তন।

২০১৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। তার আগে খালেকদাদ স্মৃতি পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা পেয়েছেন। শক্তিমান এই কবি অনেকদিন ধরে শরীরিক নানা অসুস্থ্যতায় ভুগছেন। প্রেম ও বিপ্লবের এই কবি সুস্থ হয়ে আবারও ফিরে আসুক সবার মাঝে, বেঁচে থাকুক আরও বহুদিন। শুভ জন্মদিন বাংলা কবিতার বিপ্লবী ফেরিওয়ালা।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন