শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ , ১৯ রমজান ১৪৪৫

ফিচার
  >
ব্যক্তিত্ব

সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বিশ্বসঙ্গীতের চিরবিস্ময়

নিউজজি প্রতিবেদক ৮ অক্টোবর , ২০২১, ১০:২৮:২৯

259
  • সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বিশ্বসঙ্গীতের চিরবিস্ময়

বাঙালির গৌরবের দীপ্তিময় এক নক্ষত্রের নাম ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। এই উপমহাদেশের ধ্রুপদী সঙ্গীত জগতের অমর শিল্পী তিনি। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বাঙালির এমন এক সুর সাধক যিনি সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যে এই উপমহাদেশের রাগসঙ্গীতকে পরিচিত, প্রচার ও সমাদৃত করেন। 

আজ ৮ অক্টোবর সঙ্গীত জগতের অমর শিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জন্মদিন। ১৮৬২ সালের এইদিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে এক সঙ্গীত পরিবারে তার জন্ম। তার পিতা সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সদু খাঁও ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ। 

মাতার নাম সুন্দরী বেগম। তার সঙ্গীত গুরু ছিলেন আগরতলা রাজদরবারের সভাসঙ্গীতজ্ঞ তানসেনের কন্যাবংশীয় রবাবী ওস্তাদ কাশিম আলী খাঁ। শিবপুরে এখনও রয়েছে তার মা-বাবার কবর। তার নামে গড়ে উঠেছে শিবপুর ওস্তাদ আলাউদ্দি খাঁ কলেজ। ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ ও ওস্তাদ নায়েব আলী খাঁ তার ছোট ভাই।

আলাউদ্দিনের ডাক নাম ছিল ‘আলম’। শৈশবে প্রকৃতির সান্নিধ্য খুব ভালো লাগত তার। প্রকৃতির মাঝেই তিনি খুঁজে বেড়াতেন সুর। সঙ্গীতের সেই অন্বেষণ থেকেই একটা সময় হয়ে উঠেছিলেন সুর সম্রাট। তিনি প্রচুর গান রচনা করেছেন। তার রচিত গানে তিনি ‘আলম’ ভনিতা ব্যবহার করেছেন। বাল্যকালে অগ্রজ ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁর নিকট সঙ্গীতে তার হাতেখড়ি। 

সুরের সন্ধানে তিনি দশ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এক যাত্রাদলের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। ওই সময় তিনি জারি, সারি, বাউল, ভাটিয়ালি, কীর্তন, পাঁচালি প্রভৃতি গানের সঙ্গে পরিচিত হন। 

অতঃপর কলকাতা গিয়ে তিনি প্রখ্যাত সঙ্গীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ওরফে নুলো গোপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তবে গোপাল কৃষ্ণ একটি শর্তারোপ করলেন আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণের সময় যে, কমপক্ষে ১২ বছর একনাগাড়ে সঙ্গীত সাধনা করতে হবে সেখানে থেকে। আলাউদ্দিন খাঁ রাজি হয়ে গেলেন আরোপিত শর্তে। কিন্তু সাত বছরের শেষ দিকে হঠাৎ প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন সঙ্গীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ।

সেই শোকে স্তব্ধ হয়ে আলাউদ্দিন খাঁ হঠাৎ করেই কণ্ঠসঙ্গীত সাধনা ছেড়ে দেন এবং যন্ত্রসঙ্গীত সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন করেন। স্টার থিয়েটারের সঙ্গীত পরিচালক অমৃত লাল দত্ত ওরফে হাবু দত্তের নিকট তিনি বাঁশি, পিকলু, সেতার, ম্যাডোলিন, ব্যাঞ্জু ইত্যাদি দেশী-বিদেশী বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখেন। সেই সঙ্গে তিনি লবো সাহেব নামে এক গোয়ানিজ ব্যান্ড মাস্টারের নিকট পাশ্চাত্য রীতিতে এবং বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ অমর দাসের নিকট দেশীয় পদ্ধতিতে বেহালা শেখেন। এছাড়া হাজারী ওস্তাদের নিটক মৃদঙ্গ ও তবলা শেখেন। এভাবে তিনি সর্ববাদ্য বিশারদ হয়ে ওঠেন।

বহুমাত্রিক এই সুরের জাদুকর আলাউদ্দিন খাঁ কিছুদিন ছদ্মনামে মিনার্ভা থিয়েটারে তবলা বাদকের চাকরি করেন। অতঃপর ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার জগৎ কিশোর আচার্যের আমন্ত্রণে তার দরবারে সঙ্গীত পরিবেশন করতে যান। সেখানে ভারতের বিখ্যাত সরোদিয়া ওস্তাদ আহমেদ আলী খাঁর সরোদ বাদন শুনে তিনি সরোদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তার নিকট পাঁচ বছর সরোদে তালিম নেন। 

এরপর ভারতখ্যাত তানসেন বংশীয় সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর নিকট সরোদ শেখার জন্য তিনি রামপুর যান। ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ রামপুরের নবাব হামেদ আলী খাঁর সঙ্গীত গুরু ও দরবার সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। আলাউদ্দিন খাঁ তার নিকট দীর্ঘ ত্রিশ বছর সেনী ঘরানায় সঙ্গীতের অত্যন্ত দুরূহ ও সূক্ষ্ম কলাকৌশল আয়ত্ত করেন।

কিংবদন্তি এই সঙ্গীত সাধক একটা সময় জানতে পারেন- ভারতের রামপুরের নবাবের দরবারে পাঁচশ সঙ্গীতজ্ঞ আছেন এবং এই সমস্ত ওস্তাদের প্রধান ছিলেন ওয়াজির খাঁ। তিনি তানসেনের কন্যা সরস্বতী দেবীর সরাসরি বংশধর। ওয়াজির খাঁ ছিলেন বীনকর ঘরানার। রামপুরের নবাব স্বয়ং তার শিষ্য। দরবারে নবাবের সিংহাসনের পাশেই ওয়াজির খাঁর আসন। আলাউদ্দিন খাঁর মনে হল, এমন গুণী ওস্তাদের কাছে সঙ্গীত না শিখতে পারলে তার জীবনই বৃথা।

তিনি প্রথম চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সুকৌশলে নাটকীয়ভাবে ওয়াজির খাঁর শরণাপন্ন হন। নবাব তাকে দরবারে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘এখানে সব বাদ্যযন্ত্রই আছে। তুমি কোন যন্ত্র বাজাতে পার, এখান থেকে নিয়ে বাজিয়ে শোনাও একটু।’ কারণ, ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ সবাইকে তালিম দেন না। আলাউদ্দিন খাঁ প্রথমে সরোদ তুলে নিয়ে একটা রাগ বাজালেন।

বাজনা শুনে মুগ্ধ নবাব আরো তাজ্জব হয়ে গেলেন! এরপর বেহালা হাতে তুলে নিয়ে তার সুরে মুগ্ধতায় ভাসালেন। বিস্মিত নবাব জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর কোন যন্ত্র বাজাতে জানো?’ আলাউদ্দিন খাঁ বিনয়ের সঙ্গেই বললেন, ‘আপনার দরবারে যত রকম বাদ্যযন্ত্র আছে, তার সবই বাজাতে পারি।’ নবাব অবাক হয়ে ভাবলেন- এও কি সম্ভব! 

বললেন, ‘বেশ বাজাও।’ একে একে সকল বাদ্যযন্ত্রের সুরের মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে নবাব বললেন, ‘অসাধারণ, অবিশ্বাস্য! তুমি এরকম আরো কিছু জানো নাকি যুবক?’ আলাউদ্দিন খাঁ বললেন, ‘হুজুর, যে কোন রাগ, যে কোন সুর শুনেই আমি তা কাগজে লিখে দিতে পারি।’ 

এবার নবাব নিজেই গাইতে আরম্ভ করলেন এক দুরূহ রাগের গমক। আলাউদ্দিন খাঁর পক্ষে তা লেখা মোটেও কঠিন ছিল না। কিন্তু তার মনে হল, রাজা বাদশাহরা কোন ব্যাপারে হেরে গেলে তাদের মেজাজ বিগড়ে যায়। তাই এক্ষেত্রে নবাবকে হারিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই তিনি বললেন, ‘এত বড় দুরূহ তান হুজুর! এটা আমার পক্ষে লেখা সম্ভব নয়।’

এমন জবাব শুনে ভারি খুশি হন নবাব। তিনি বিরাট একটা রূপার থালা ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা, মূল্যবান বস্ত্র ও নানা রকম খাদ্য সামগ্রী উপঢৌকন হিসাবে ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর কাছে পাঠিয়ে আলাউদ্দিন খাঁকে তার শিষ্যত্বে বরণ করে নেয়ার আহ্বান জানান। নবাবের দরবারে এক জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আলাউদ্দিন খাঁকে শিষ্য হিসাবে বরণ করে নেন ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ। আলাউদ্দিন খাঁ তার নিকট দীর্ঘ ত্রিশ বছর সেনী ঘরানায় সঙ্গীতের অত্যন্ত দুরূহ ও সূক্ষ্ম কলাকৌশল আয়ত্ত করেন।

১৯১৮ সালে নবাব তাকে মধ্য প্রদেশের মাইহার রাজ্যে প্রেরণ করেন। মাইহারের রাজা ব্রিজনারায়ণ আলাউদ্দিন খাঁকে নিজের সঙ্গীত গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত করলে তিনি মাইহারে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বেরিলির পীর সাহেবের প্রভাবে তিনি যোগ, প্রাণায়াম ও ধ্যান শেখেন। ১৯২০-২১ সালের দিকে তিনি দেশে ফিরে বেশ কিছুদিন পরিবার পরিজনের সঙ্গে কাটান। ১৯২২ সালে শিবপুরে তার প্রথম পুত্র ওস্তাদ আলী আকবর খান-এর জন্ম হয়।

হঠাৎ করে গুরুপুত্র পিয়ার মিঞা মৃত্যুবরণ করলে গুরু ওস্তাদ উজীর খাঁ তাকে ডেকে পাঠান। তিনি তার অধীস্ত সকল বিদ্যা প্রিয় শিষ্য ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে সমর্পনের ইচ্ছা পোষণ করেন। ফলে গুরুর কাছে তিনি পুনরায় শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেন। কয়েক বছরের মাথায় ওস্তাদ উজীর খাঁ দেহত্যাগ করেন।

বহুমাত্রিক সঙ্গীত যন্ত্রে পারদর্শী আলাউদ্দিন খাঁ সরোদে বিশেষভাবে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। সহজাত প্রতিভাগুণে তিনি সরোদবাদনে ‘দিরি দিরি’ সুরক্ষেপণের পরিবর্তে ‘দারা দারা’ সুরক্ষেপণ-পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। সেতারে সরোদের বাদনপ্রণালী প্রয়োগ করে সেতারবাদনেও তিনি আমূল পরিবর্তন আনেন। এভাবে তিনি সঙ্গীত জগতে এক নতুন ঘরানার প্রবর্তন করেন, যা ‘আলাউদ্দিন ঘরানা’ বা ‘মাইহার ঘরানা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। যোগ্য শিষ্য তৈরি তার এক বিশাল কীর্তি। 

আলাউদ্দিন খাঁ তার সফল শিষ্যদের মধ্যে তিমিরবরণ, পুত্র আলী আকবর খান, জামাতা পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ভ্রাতুষ্পুত্র বাহাদুর হোসেন খান, কন্যা রওশন আরা বেগম (অন্নপূর্ণা), পান্নালাল ঘোষ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের পরামর্শ ও নির্দেশে কয়েকটি নতুন বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবিত হয়। সেগুলির মধ্যে ‘চন্দ্রসারং’ ও ‘সুরশৃঙ্গার’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

তিনি অনেক রাগ-রাগিণীও সৃষ্টি করেন। যেমন- হেমন্ত, দুর্গেশ্বরী, মেঘবাহার, প্রভাতকেলী, হেম-বেহাগ, মদন-মঞ্জরী, মোহাম্মদ(আরাধনা), মান্ঝ খাম্বাজ, ধবলশ্রী, সরস্বতী, ধনকোশ, শোভাবতী, রাজেশ্রী, চণ্ডিকা, দীপিকা, মলয়া, কেদার মান্ঝ, ভুবনেশ্বরী ইত্যাদি।

১৯৫২ সালে ভারত সরকার তাকে সঙ্গীত নাটক আকাদেমি সম্মান’ ১৯৫৮ সালে ‘পদ্মভূষণ’, ১৯৭১ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’, ১৯৬১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ‘দেশিকোত্তম’ এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডক্টর অব ল’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৫৪ সালে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক প্রথম সঙ্গীত নাটক আকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হল তাকে আজীবন সদস্যপদ দান করে।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর তালিমের গুণে তার পুত্র সরোদশিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খান বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন। ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’ ও ‘পদ্মবিভূষণ’ এবং তার জামাতা সেতার শিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর বিশ্বখ্যাত হয়েছেন এবং ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’, ‘পদ্মবিভূষণ, ও ‘ভারতরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।

তিনি উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু সমাজসেবামূলক কাজ করেছেন। শিবপুর গ্রামে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেছেন এবং পানি পানের জন্য একটি পুকুর খনন করিয়ে দিয়েছেন। তার নির্মিত মসজিদটি এখনও তার স্মৃতিবহন করে চলছে। মাইহার রাজ্যে, ‘মাইহার কলেজ অব মিউজিক’ প্রতিষ্ঠা তার সঙ্গীত জীবনের এক শ্রেষ্ঠতম একটি অবদান। 

১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মধ্য প্রদেশের মাইহারেরই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জীবনাবসান ঘটে। অনন্য কীর্তির মধ্য দিয়ে সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ জীবন-মরণের সীমানা ছাড়িয়ে হয়ে আছেন বিশ্বসঙ্গীতের চিরবিস্ময়।

নিউজজি/রুআ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন