শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২ , ২৭ শাওয়াল ১৪৪৬

ফিচার
  >
ভ্রমণ

স্বপ্নরাজ্য ডিজনিল্যান্ড

নিউজজি ডেস্ক ৩ নভেম্বর , ২০২৪, ১৩:০৪:০৮

186
  • সংগৃহীত

ঢাকা: ১৯৫৫ সালে যখন প্রথমবারের মতো ডিজনিল্যান্ড দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় তখন অনেকেই নতুন এই থিম পার্কের সাফল্য নিয়ে সন্দিহান ছিল। অবশ্য নিন্দুকদের যাবতীয় সন্দেহ হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে বেশি সময় নেয়নি ডিজনিল্যান্ড। উদ্বোধনের পর থেকে আজ পর্যন্ত থিম পার্কের ইতিহাসে এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ থিম পার্ক বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।

ডিজনিল্যান্ডের শুরুটা হয়েছিল একটি সমস্যার সমাধান খোঁজার মধ্য দিয়ে। একদিন ওয়াল্ট ডিজনি গ্রিফিথ পার্কের একটি বেঞ্চে বসে ছিলেন। সেসময় তার দুই মেয়ে সেই পার্কের মেরি-গো-রাউন্ড ক্যারোজেলে চড়ে হৈ-হুল্লোড় করছিল। তিনি ভাবলেন, যদি পার্কগুলো এমন হতো যে, বাবা-মা-ছেলে-মেয়ে সবার জন্যই পর্যাপ্ত আনন্দের ব্যবস্থা থাকত তাহলে কতই না ভালো হত! কিন্তু সেসময় এ ধরনের স্বয়ংসম্পূর্ণ অ্যামিউজমেন্ট পার্কের কোনো অস্তিত্বই ছিল না।

এই সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি এমন একটি পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করলেন যেখানে পরিবারের সবার উপযোগী বিভিন্ন রাইড থাকবে এবং সবাই পার্কে এসে আনন্দঘন সময় কাটাতে পারবে। এছাড়াও ওই পার্কে সবাই বিভিন্ন কার্টুন চরিত্রের সাথে বাস্তবেও সাক্ষাৎ করতে পারবেন। বর্তমানের আমরা যে বিশ্বখ্যাত ডিজনিল্যান্ডের সাথে পরিচিত তা ওয়াল্ট ডিজনির সেই পরিকল্পনারই ফসল।

তার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য প্রয়োজন ছিল বিপুল সংখ্যক লোকবল এবং আধুনিক সব প্রযুক্তির। ফলে ১৯৫২ সালে ওয়াল্ট ডিজনি ওয়েড এন্টারপ্রাইজেস (WED Enterprises; WED = Walter Elias Disney) নামক একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ডিজনিল্যান্ড তৈরিতে নিবিড়ভাবে কাজ করার জন্য তিনি এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি তার স্বপ্ন সত্যি করার জন্য অসাধারণ সব ইঞ্জিনিয়ার, কার্পেন্টার ও বিজ্ঞানীসহ নানা পেশাজীবির মানুষকে এই কোম্পানির আওতায় নিয়ে আসেন।

ধীরে ধীরে কলেবরে বাড়তে থাকে ওয়েড এন্টারপ্রাইজেসের আকার। অবশ্য এই কোম্পানির বর্তমান নাম ইমাজিনিয়ারিং (Imagineering), কারণ ওয়েড এন্টারপ্রাইজেসের কর্মীদের কাজ ছিল নতুন কিছু কল্পনা করা বা Imagine করা এবং তা ইঞ্জিনিয়ারদের সাহায্যে বাস্তবে রূপ দেয়া। Imagine এবং Engineer শব্দ দুটি ব্যবহার করে পরবর্তীতে কোম্পানির নতুন নাম হয় ইমাজিনিয়ারিং।

ডিজনিল্যান্ড তৈরির ক্ষত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি ছিল সঠিক স্থান নির্বাচন। কারণ এই থিম পার্কের জন্য এমন একটি স্থান দরকার ছিল যেখানে অনায়েসে একাধিক কৃত্রিম পাহাড়, নদী, জলপ্রপাতসহ বিশাল বিশাল সব স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর ক্যালিফোর্নিয়ার আনাহেইম শহরের স্যান্টা এনা ফ্রিওয়ের নিকটে ১৬০ একরের একটি জমি ডিজনিল্যান্ডের জন্য পছন্দ করা হয়।

অবশেষে ২১ ডিসেম্বর, ১৯৫৪ থেকে নির্মাণ শুরু হয় ডিজনিল্যান্ডের। ১৬০ একর জমি জুড়ে থাকা বিভিন্ন গাছপালা কেটে সাফ করা হয় প্রথমে। এরপর শুরু হয় বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ।

ওয়লাট ডিজনি খুব ভালো করেই জানতেন যে সম্পূর্ণ ডিজনিল্যাড গড়ে তুলতে তার বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে। তাই অর্থের সংস্থান করতে তিনি দ্বারস্থ হন সে সময়ের তিনটি বৃহৎ টেলিভিশন নেটওয়ার্ক– NBC, CBS এবং ABC এর নিকট। এদের মধ্যে শুধুমাত্র এবিসি নেটওয়ার্ক ডিজনিল্যান্ড প্রকল্পে পাঁচ লক্ষ ডলার বিনিয়োগ করতে রাজি হয় এবং এই বিনিয়োগের ফলে তারা ডিজনিল্যান্ডের ৩৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক বলে যায়।

এবিসি নেটওয়ার্কের সাথে এই চুক্তি ওয়াল্ট ডিজনির অসাধারণ দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে। কারণ চুক্তি অনুযায়ী তাকে এবিসি চ্যানেলের জন্য “ডিজনিল্যান্ড” নামে একটি সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান তৈরি করতে হয়েছিল। প্রতি সপ্তাহে প্রচারিত এই অনুষ্ঠানে তখন ডিজনিল্যান্ড নির্মাণের নানা খুঁটিনাটি দিক এবং ছোট্ট একটি মুভি দেখানো হত। এর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল মানুষকে ডিজনিল্যান্ড সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলা এবং এই উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়েছিল।

টেলিভিশন কোম্পানি ছাড়াও ওয়াল্ট ডিজনি অন্যান্য ভোগ্য পণ্য কোম্পানিগুলোরও দ্বারস্থ হন। একবার ডিজনিল্যান্ড চালু হয়ে গেলে সেখানে এসব কোম্পানির পণ্য যে বিপুল পরিমাণে বিক্রি হবে তা কোম্পানির কর্মকর্তাদের সামনে তুলে ধরেন ওয়াল্ট ডিজনি। ফলে কোকাকোলা, সুইফট, ইস্টম্যান কোডাক, ফ্রিটো-লেইয়ের মতো বড় কোম্পনিগুলো ডিজনিল্যান্ড প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়। ডিজনিল্যান্ড তৈরিতে এসব কোম্পানির বিনিয়োগ খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ ডিজনিল্যান্ড তৈরিতে খরচ হয়েছিল প্রায় ১৭.৫ মিলিয়ন ডলারের মতো। এত বিশাল পরিমাণ অর্থ ওয়াল্ট ডিজনির একার পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিল না।

অবশ্য বিনিয়োগের ফলে এসব কোম্পনি ডিজনিল্যান্ডের একটি বড় অংশের শেয়ারের মালিক বনে যায়। পরবর্তীতে ডিজনিল্যান্ড উদ্বোধনের পর যখন তা লাভের মুখ দেখতে থাকে তখন ধীরে ধীরে ওয়াল্ট ডিজনি এসব শেয়ার কিনে নিতে থাকেন। শেষপর্যন্ত ডিজনিল্যান্ডে শুধুমাত্র এবিসি নেটওয়ার্কের শেয়ার টিকে ছিল। ডিজনি কোম্পানি পরে একসময় এবিসি নেটওয়ার্ককেই কিনে নেয়। ফলে ডিজনিল্যান্ডের ওপর ডিজনি কোম্পানির একচ্ছত্র আধিপত্য নিশ্চিত হয়।

অর্থের যোগান নিশ্চিত হবার ফলে ডিজনিল্যান্ড জুড়ে একে একে গড়ে উঠতে থাকে ফ্রন্টিয়ারল্যান্ড, অ্যাডভেঞ্চারল্যান্ড, টুমরোল্যান্ড, ফ্যান্টাসিল্যান্ডের মতো থিম পার্কগুলো। অ্যাডভেঞ্চারল্যান্ডে গড়ে তোলা হয় আফ্রিকা, এশিয়া, আমেরিকা ইত্যাদি অঞ্চলের জঙ্গলগুলোর মতো বন্য পরিবেশ। যারা সভ্যতাকে ভুলে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশে হারিয়ে যেতে চান তাদের জন্য তৈরি করা হলো এই অ্যাডভেঞ্চারল্যান্ড।

অন্যদিকে ভবিষ্যৎ দুনিয়ার মতো করে তৈরি করা কাল্পনিক এক জগত হলো ডিজনির টুমরোল্যান্ড। এখানকার অসাধারণ সব রাইড সবাইকে নিমিষেই যেন নিয়ে যায় বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের জগতে। অবশ্য ডিজনিল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় থিম পার্ক সম্ভবত ফ্যান্টাসিল্যান্ড। একে তৈরি করা হলো জাদুবাস্তবতার এক অপূর্ব মিশেলে। এই ফ্যান্টাসিল্যান্ডে রয়েছে একটি বিশালাকার স্লিপিং বিউটি ক্যাসল এবং একটি ফ্যান্টাসি ভিলেজ।

ডিজনিল্যান্ড নির্মাণের সকল ক্ষেত্রে সরাসরি যুক্ত থাকতে চেয়েছিলেন ওয়াল্ট ডিজনি। তিনি সপ্তাহে একাধিকবার নির্মাণাধীন পার্ক পরিদর্শনে যেতেন। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে, নিয়োগকৃত ডিজাইনারের কোনো ডিজাইন তার পছন্দ না হওয়ায় তিনি নিজেই সেই অংশের ডিজাইন করে দিয়েছিলেন।

এরকম একটি ঘটনা ঘটেছিল ‘টম সয়্যার আইল্যান্ড’ ডিজাইনের ক্ষেত্রে। ডিজাইনারের করা ডিজাইন ওয়াল্ট ডিজনির মোটেও মনঃপুত হয়নি। তিনি ভাবলেন, ডিজাইনার হয়তো পুরো ব্যাপারটি ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারেননি। তাই তিনি নিজে পরদিন ‘টম সয়্যার আইল্যান্ডের’ ডিজাইন নিয়ে হাজির হয়েছিলেন।

ধীরে ধীরে ডিজনিল্যান্ড তার গ্র্যান্ড উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে। শ্রমিকেরা রাত-দিন এক করে কাজ করে যাচ্ছিল। সব কিছুই ঠিকঠাক মতো চলছিল। ওয়াল্ট ডিজনির স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল এবং ডিজনিল্যান্ড বিশ্ববাসীর জন্য উন্মুক্ত করে দেবার অপেক্ষায় প্রহর গুনছিল।

উদ্বোধনী দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে আয়োজনের কোনো কমতি ছিল না। ছয় হাজার আমন্ত্রিত অতিথি উপস্থিত ছিলেন ঐদিন। তাদের মধ্যে হলিউড অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংখ্যাই ছিল বেশি। এছাড়াও ২৮ হাজারের বেশি মানুষ ভিড় জমিয়েছিল ডিজনিল্যান্ডের বাইরে। অবশ্য এদের বেশিরভাগের কাছেই ছিল ডিজনিল্যান্ডের জাল টিকিট। ঐদিন পৃথিবীর বুকে নতুন এই বিস্ময়কে দেখতে মানুষের মাঝে সে কী উত্তেজনা! সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান এবিসি চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করেছিল।

১৭ জুলাই, ১৯৫৫-তে উদ্বোধন হওয়ার পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে পঞ্চাশ মিলিয়ন দর্শনার্থী ডিজনিল্যান্ড ভ্রমণ করে। ডিজনিল্যান্ডের এই জনপ্রিয়তা সময়ের সাথে সাথে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই একবিংশ শতাব্দীতেও এটি তার সম্মোহনী ক্ষমতা পুরোপুরি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

ওয়াল্ট ডিজনি একবার বলেছিলেন, ”ডিজনিল্যান্ড নির্মাণ কখনোই শেষ হবে না।“ তার এই উক্তিটি আজও সঠিক বলে প্রমানিত হচ্ছে। যখন বিশ্ববাসীর সামনে ডিজনিল্যান্ডকে উন্মুক্ত করা হয়েছিল তখন এটি ছিল ১৬০ একর ভূমি জুড়ে বিস্তৃত একটি পার্ক এবং এর অভ্যন্তরে একটি মাত্র হোটেলের উপস্থিতি ছিল। অথচ বর্তমানে এটি ৫১০ একর জমি জুড়ে গড়ে ওঠা একটি রিসোর্টে পরিণত হয়েছে। এর ভেতরে রয়েছে সর্বমোট ২,২২৪টি কক্ষের তিনটি বিশাল হোটেল এবং একটি শপিং কমপ্লেক্স। রিসোর্টের ভেতরে বিভিন্ন কাল্পনিক চরিত্রে প্রতিনিয়ত অভিনয় করছে প্রায় বিশ হাজারের মতো মানুষ। ১৯৫৫ সালে ডিজনিল্যান্ড নামের যে পার্কের সৃষ্টি হয় পৃথিবীর বুকে তা ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হতে হতে বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ থিম পার্কের মর্যাদা লাভ করেছে।

ডিজনিল্যান্ডের সকল সাফল্য দেখে যেতে পারেননি ওয়াল্ট ডিজনি, এর আগেই ১৯৬৬ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। কিন্তু তার স্বপ্নের ডিজনিল্যান্ড এবং তার ডিজনি কোম্পানির অসাধারণ সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে পৃথিবীবাসীর মনে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল। - রোয়ার মিডিয়া

নিউজজি/ পি.এম

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন