রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩ মাঘ ১৪৩১ , ২৬ রজব ১৪৪৬

বিদেশ

সিরিয়ায় নতুন নেতৃত্বের উত্থান, অস্তিত্ব সংকটে মার্কিন মিত্র কুর্দিরা?

নিউজজি ডেস্ক ১২ ডিসেম্বর , ২০২৪, ১৬:০১:১৮

54
  • ছবি : ইন্টারনেট

ঢাকা: সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদকে উৎখাতকারী জিহাদি বিদ্রোহীরা বলেছে, তারা একটি ঐক্যবদ্ধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ গড়তে চায়। তবে প্রায় ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধের পর দেশটিতে সেই আদর্শের বাস্তবে প্রয়োগ করা সহজ হবে না। সিরিয়ায় আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র কুর্দি সংখ্যালঘুদের জন্য সেখানে একটি নতুন শৃঙ্খলা বাস্তবায়ন আরও চ্যালেঞ্জিং পর্যায়ে প্রবেশ করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাহলে সিরিয়ার ভবিষ্যত কি? রাষ্ট্রবিহীন সংখ্যালঘু কুর্দিদেরই বা কি পরিণতি হবে—এই প্রশ্নেরই জবাবে খোঁজা হয়েছে মার্কিন বার্তা সংস্থা এটির একটি প্রতিবেদনে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ চলাকালীন কুর্দি যোদ্ধারা ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীকে পরাস্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মেলায়। পরে দেশটির তেল সমৃদ্ধ পূর্বাঞ্চলে একটি স্বায়ত্তশাসিত ডেরা তৈরি করে তারা।

তবে অনারব কুর্দিদের সেই অর্জন এখন ঝুঁকির মুখে পড়েছে। আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে সুন্নি আরব বিদ্রোহীদের উত্থান কুর্দিদের জন্য নতুন সিরিয়ায় জায়গা করে নেওয়া কঠিন করে তুলবে। এমনকি এই সংঘাত দীর্ঘায়িত হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। কুর্দিদের দীর্ঘদিনের শত্রু তুরস্ক অবশ্য সুন্নী বিদ্রোহীদের এই হামলায় সহায়তা করেছে বলে ধারণা করা হয়। যদিও এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে তুর্কি কর্তৃপক্ষ।

জিহাদি বিদ্রোহীরা সপ্তাহান্তে দামেস্কে প্রবেশ করে কুর্দিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে একটি প্রাথমিক চুক্তিতে পৌঁছেছে। তবে সরকারি বাহিনী শহরটি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কয়েকদিন পরই কুর্দি যোদ্ধাদের পূর্বাঞ্চলীয় শহর দেইর আল-জোর থেকে তাড়িয়ে দেয় বিদ্রোহীরা।

সিরিয়ার উত্তরে তুরস্ক সমর্থিত একটি পৃথক বিরোধী দল বছরের পর বছর ধরে কুর্দিদের সঙ্গে লড়াই করছে। কুর্দিদের তাড়িয়ে মানবিজ শহরটি দখলে নিয়েছে তারা। এছাড়া, একটি কুর্দি কাফেলার ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে তুরস্ক। দেশটি দাবি করেছিল, সরকারি অস্ত্রাগার থেকে লুট করা ভারী অস্ত্র বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল কাফেলাটি।

এই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন সাহায্যের ওপর নির্ভর করছে কুর্দিরা। প্রায় ৯০০ মার্কিন সেনা পূর্ব সিরিয়ায় রয়েছে, যেখানে তারা ইসলামিক স্টেটের পুনরুত্থান রোধে কুর্দি বাহিনীর সঙ্গে অংশীদারিত্ব ভাগ করে নিয়েছে। তবে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে সেই মিশনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে বলে মনে করছেন অনেকেই। কেননা, দীর্ঘদিন ধরেই ট্রাম্প সিরিয়া ইস্যুতে মার্কিন সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে আসছেন।

কুর্দিরা এখন যে দুর্দশার মধ্যে রয়েছে তার একটি একটি দৃষ্টিভঙ্গি এপির আলোকে তুলে ধরা হলো:

সিরিয়ায় মার্কিন মিত্র কুর্দি যোদ্ধারা কারা?

বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্রহীন জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর একটি কুর্দিরা। তুরস্ক, ইরান, ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলে প্রায় ৩ কোটি কুর্দির বসবাস। প্রতিটি দেশেই তারা সংখ্যালঘু এবং প্রায়ই নিপীড়নের শিকার হয়েছে, যা সশস্ত্র কুর্দি বিদ্রোহের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে।

সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে একটি স্বায়ত্তশাসিত ছিটমহল তৈরি করেছিল কুর্দিরা। তবে তারা আসাদ সরকারকে বা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বিদ্রোহীদের কাউকেই পুরোপুরি সমর্থন করেনি গোষ্ঠীটি।

২০১৪ সালে সিরিয়ার এক তৃতীয়াংশ দখল করে নেয় ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠী। তখন কুর্দি যোদ্ধাদের মধ্যে যারা ধর্মনিরপেক্ষ এবং তাদের র‌্যাংকে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করে, চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক যুদ্ধে তাদের দক্ষতা প্রমাণ করেছিল। আর এর মধ্য দিয়ে গোষ্ঠীটি মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট থেকে সমর্থন অর্জন করেছিল।

সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) নামে একটি দল গঠন করে তারা। এই দলে আরব যোদ্ধারাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। গোষ্ঠীটি মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিমান হামলা ও আমেরিকার বিশেষ বাহিনীর সহায়তায় সিরিয়ার বিশাল এলাকা থেকে ইসলামিক স্টেটকে তাড়িয়ে দেয়। ২০১৭ সালে কুর্দি নেতৃত্বাধীন এই বাহিনী চরমপন্থিদের তাদের নিজ ধাচের খিলাফতের রাজধানী রাক্কা দখল করে।

তুরস্ক কেন কুর্দিবিরোধী?

দীর্ঘদিন ধরে এসডিএফকে নিজ সীমানার মধ্যে দশকের পুরনো কুর্দি বিদ্রোহের সম্প্রসারণ হিসেবে দেখে আসছে তুরস্ক। দেশটি প্রধান কুর্দি উপদলটিকে ইসলামিক স্টেটের মতন একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে। নতুন সিরিয়ায় তাদের উপস্থিতি থাকা উচিত নয় বলেও মন্তব্য করেছে আঙ্কারা।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্ক সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এসএনএ) নামে পরিচিত যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন করেছে। তারা তুরস্কের সীমান্ত বরাবর উত্তর সিরিয়ার কুর্দিদের কাছ থেকে অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নিতে সাহায্য করছে। তুর্কি সমর্থিত এই যোদ্ধারা নিজেদের আসাদবিরোধী বলে চিত্রিত করলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, তারা মূলত সুবিধাবাদ ও কুর্দিদের বিদ্বেষী মনোভাব দিয়ে পরিচালিত।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কুর্দিরা এসএনএ’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দিকে মনোনিবেশ করেছে। তবে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, তুরস্কের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক থাকা দামেস্কের নতুন এই নেতৃত্ব সংঘাতের আরও একটি দীর্ঘ ফ্রন্ট খুলতে পারে।

কুর্দিদের যেভাবে দেখে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা

প্রধান বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছেন আহমাদ আল-শারা, পূর্বে যিনি আবু মোহাম্মদ আল-গোলানি নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি আট বছর আগে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। আল-শারা তখন বলেছিলেন, তিনি একনায়কতন্ত্রমুক্ত একটি নতুন সিরিয়া গড়তে চান যেটি দেশের সব ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রদায়ের সেবায় নিয়োজিত থাকবে।

জার্মানি ভিত্তিক সেন্টার ফর কুর্দিস স্টাডিজের প্রধান নওয়াফ খলিল বলেন, প্রাথমিক লক্ষণগুলো ইতিবাচক বলেই মনে হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, বিদ্রোহীরা আলেপ্পোর দুটি এসডিএফ-নিয়ন্ত্রিত ছিটমহল থেকে সরে যায়। অথচ দুই সপ্তাহ আগে যখন সারাদেশে তারা দ্রুত অগ্রসর হতে শুরু করে তখন এই শহরে আক্রমণ চালিয়ে এটি দখলে নিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘এটিও ইতিবাচক যে, তারা সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক বাহিনী সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলেনি।’

সেই অনুভূতিগুলো টিকে কি-না সেটাই এখন দেখার বিষয়। চলতি সপ্তাহে দেইর আল-জোরে হামলার পর আল-শারার গোষ্ঠীর একজন যোদ্ধা একটি ভিডিও প্রকাশ করেন। সেটিতে তাকে বলতে শোনা যায়, তারা শিগগিরই রাক্কা ও পূর্ব সিরিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হবে। এই অঞ্চলগুলো কুর্দিদের ঢেরা। ফলে এতে কুর্দিদের সঙ্গে আরও সংঘর্ষের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিদ্রোহীরা আসাদ পরবর্তী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে কুর্দিদের সঙ্গে কিছু চুক্তি করতে চাইতে পারে। তবে এর জন্য সম্ভবত পূর্বে কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসনকে বিদ্রোহীদের মেনে নিতে হবে। এমনটি হলে তা তুরস্ককে ক্ষুব্ধ করার মতো ঝুঁকিও তৈরি করবে। দেশটিকে এখন সিরিয়ার প্রধান ক্ষমতার মধ্যস্ততাকারী বলেই মনে করা হচ্ছে।

কুর্দিদের সমর্থন করবে ট্রাম্প প্রশাসন?

আসাদ পরবর্তী জোটের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের প্রতিশ্রুতির একটি ইঙ্গিত হিসেবে মঙ্গলবার সিরিয়ায় এসডিএফ বাহিনীর সঙ্গে দেখা করেছেন মধ্যপ্রাচ্যে শীর্ষ মার্কিন সামরিক কমান্ডার আর্মি জেনারেল এরিক কুরিলা।

তবে বর্তমান প্রশাসন সমর্থনের ইঙ্গিত দিলেও ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের আনুষ্ঠানিক অভিষেকের পর অনেক কিছুরই পরিবর্তন হতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্য নীতির বিষয়ে কিছু বিশদ বিবরণ দিয়েছেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট। একদিকে ট্রাম্প যেমন এই অঞ্চলের যুদ্ধের অবসান ঘটাতে চান, তেমনি অন্যদিকে তিনি আবার যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের থেকে দূরেও সরিয়ে রাখতে চান।

আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার কিছুক্ষণ আগে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করা একটি পোস্টে ট্রাম্প লিখেছিলেন, ‘সিরিয়ার হ-য-ব-র-ল অবস্থা। তবে এটি আমাদের বন্ধু নয়। আর তাই যুক্তরাষ্ট্রেরও এ নিয়ে কিছু করার নেই। এটি আমাদের লড়াই নয়।’

প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মেয়াদের সময়, ২০১৯ সালে একটি তুর্কি অনুপ্রবেশের আগে কুর্দিদের পরিত্যাগ করেছিলেন ট্রাম্প। এই পদক্ষেপকে তিনি এই অঞ্চলের ‘অন্তহীন যুদ্ধে’ মার্কিন সংশ্লিষ্টতা বন্ধের যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন তার পূর্ণতা হিসেবে অভিহিত করেন।

তার এমন পদক্ষেপ তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। বিশিষ্ট রিপাবলিকানরা একে মিত্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলেও অভিযোগ করেছিলেন। এর কয়েক সপ্তাহ পর, পূর্বে তেল ক্ষেত্রগুলোকে সুরক্ষিত করতে একটি বিস্তৃত মিশনের অনুমোদন দেওয়ার মাধ্যমে নিজ অবস্থান থেকে সরে আসেন ট্রাম্প। সেনারা যেখানে ছিলেন সেখানেই রয়ে যান এবং জোটটিও টিকে যায়।

নিউজজি/পি.এম

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন