সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২ , ১৪ জিলকদ ১৪৪৬

সাহিত্য

দহন (পর্ব -৪)

নাবিলা শারমিন ২৫ এপ্রিল , ২০২৫, ১৩:৪৬:১৯

309
  • নাবিলা শারমিন

আমার অপেক্ষা শেষ হল। উনি এলেন। মুহম্মদ ইকবাল। আমার বাবা, যে কোনো দিনও আমার কোনো খোঁজ রাখেন নি, আমার কোনো কাজে আসেন নি। তবে তাঁর নামটা সব সময় আমার কাজে লেগেছে।  স্কুল, কলেজ, জাতীয় ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সময়। বোর্ড পরীক্ষা দেয়ার সময়। কী আজব এই দুনিয়া!

অনেক কিছু নিয়ে এসেছেন তিনি, অনেক খাবার।

দুরকম মিষ্টি, অনেক রকম ফল, একটা আইসক্রিম কেক, বড় একটা পিজ্জা। খালার জন্য শাড়ি এনেছেন একটা।

উনি নিশ্চয়ই  নিজের বাড়িতেও এমনই খাবার কেনেন ওনার মেয়েদের জন্য। অনেক ভাল বাবা নিশ্চয়ই তাদের কাছে। এক টুকরো পিজ্জা খাব কি না ভাবছিলাম।  আসলে এ বাড়িতে সব সময়ই আমাকে ভাবনা চিন্তা করে খেতে হয়েছে। আমি জানি না পেটির মাছের স্বাদ কেমন হয়, মুরগির রানের স্বাদ কেমন হয়।   আজ নিজের বাবা এনেছেন তাও মনে হচ্ছে,  এখনই খাব, পরে যদি কেউ খুঁজে খাওয়ার জন্যে?

অবশ্য উনি তো আর আমার বাবা হয়ে আসেন নি, মেহমান হয়ে এসেছেন।

আমার ডাক পরল কিছুক্ষণ পর। গেলাম আমি, উনি গভীর চোখে তাকিয়ে হালকা হেসে বললেন, 

—কেমন আছ?

—কেমন দেখছেন?

উনি এমন একটা উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন, পড়াশোনা কেমন চলছে?

 —ছেড়ে দিয়েছি।  বিয়েই তো করছি। নানির সব টাকা বিয়েতেই শেষ হয়ে যাবে। পড়াশোনা করব কী দিয়ে?

চুপ হয়ে গেলেন উনি। কিছুক্ষণ পর বললেন,

—বিয়েটা তুমি করতে চাও?

—না চাইলে কি বিয়েটা আটকাতে পারবেন আপনি? কোনো গতি করতে পারবেন আমার?

উনি বুঝছিলেন আমার ভেতরে জমে থাকা বহ্নি, লাভা হয়ে বের হচ্ছে।

উনি বললেন পারব, হয়ত তোমাকে নিজের কাছে রাখতে পারব না। হোস্টেলে রেখে পড়াতে পারব। তুমি পড়ালেখা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের পছন্দমতো কাওকে বিয়ে করবে।

—না এত কষ্ট আপনাকে করতে হবে না, এতদিন যখন অন্যমানুষের ঘাড়ে নিশ্চিন্তে ফেলে রাখতে পেরেছেন আজ কেন শুধু শুধু ঝামেলা ঘাড়ে করবেন?  আপনার বউ, মেয়েরা ব্যাপারটা পছন্দ করবে না।

—দেখো মা আমি জানতাম তোমার মামা খালারা খুব ভাল মানুষ, উনারা তোমাকে নিজের বাচ্চার মতো করেই রাখবে।

—ওহ তাই? তাহলে আজকে তাদের পছন্দ করা ডিসের ব্যাবসার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইছেন না কেন? ওনাদের থেকে বিয়ের দিন তারিখ শুনে যান, আপনার বউ মেয়েরা অনুমতি দিলে গরিবের বিয়ে এসে দেখে যাবেন।

উনি ভেতরে ভেতরে একটু একটু করে ভাঙছিলেন।

শুষ্ক গলায় বললেন, বুঝতে পারি নি এমন হবে। তাইই এতক্ষণ ধরে উনাদের জিজ্ঞেস করছিলাম কীভাবে এমন বিয়ে ঠিক করল তারা। এমন একটা ছেলে.... 

আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না চিৎকার করে উঠলাম, উনাদের জিজ্ঞেস করছিলেন মানে? উনাদের জিজ্ঞেস করার আপনি কে? কে আপনি?

মরে গেছি কি না তাও জানার প্রয়োজন বোধ করেন নি কোনো দিন। আর আজ জিজ্ঞেস করতে এসেছেন তাদের কাছে, যাদের কোন দায়িত্ব ছিল না তবুও দয়া করে থাকতে দিয়েছে, খেতে দিয়েছে, মানুষ করেছে?

ফাজলামি করেন আমার সাথে? আর কিছু বলতে পারলাম না। বলার মতো অবস্থা ছিল না। আমার সারা মুখ ভিজে গেছে। জল গড়িয়ে বুকের কাছেও অনেকটা ভিজিয়ে দিয়েছে। লোকটাও কাঁদছে।

কান্না জড়ানো গলায় তিনি বললেন,

—আর পাঁচটা লোকের মতো আমিও তোমার মা আর তোমাকে নিয়ে সুন্দর সংসার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমার মা কোনোদিনই আমাকে ভালবাসতে পারে নি। তবুও আমি অনেক চেষ্টা করেছি। ভেবেছিলাম আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি হওয়ার পর ভেবেছিলাম, যাক যেমন করেই হোক সংসারটা চলে তো যাচ্ছে। আরও বাচ্চাকাচ্চা হলে আমি এই বাচ্চাগুলোর ভালবাসা নিয়েই থাকব। যখন তোমার দেড় বছর বয়স তোমার মা চলে গেল। এত ছোট ছিলে তুমি আমার একার পক্ষে তোমার দেখাশোনা করা সম্ভব ছিল না। তোমাকে তোমার নানির কাছে রেখে এলাম। তোমার সব খরচ আমিই দিতাম তখনও। তারপর তোমার দাদি-ফুফুরা চাইল আমি আবার সংসারী হই। আমি নিজেও তাই চাইছিলাম। 

তোমার মায়ের অবহেলা আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছিল। তার চলে যাওয়ার পর আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারতাম না। এত অপমান, অসম্মান সে আমাকে দিয়েছিল, আমার বাঁচার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছিল।

আমি নতুন করে বাঁচতে চাইছিলাম, একটু ভালবাসা পাওয়ার জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। একটা স্বাভাবিক সংসার চাইছিলাম অন্য পাঁচটা মানুষের মতো।

নতুন বিয়ে করার পর আমার স্ত্রীর শর্ত ছিল পুরোনো কিছু নতুন জীবনে কোনোভাবেই টানতে পারব না।

আমি আমার নতুন জীবনে আর কোন অশান্তি চাইছিলাম না কোনোভাবেই।

ভেবেছিলাম এরা নিজের মেয়ের মতো করেই রাখবে তোমাকে। অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি আমি মা।

এই ভুলের ক্ষমাও নেই। তবুও তুমি এমন জিদ করে, নিজেকে আর কষ্ট দিও না।তোমার ছোট বেলায় তোমার নানির মুখে শুনেছিলাম তুমি জজ হতে চাও।  তোমার বয়স বেশি না। আমি তোমাকে খুব ভালো একটা ল” কলেজে ভর্তি করিয়ে দিই।

আমি বললাম ভালই ভেবেছিলেন, নিজের সুখের জন্য নিজের মেয়ের কোনো দায়িত্ব, খোঁজ কিচ্ছু নিতে পারেন নি আর ভেবেছিলেন অন্য লোকে রাজকুমারী করে মাথায় তুলে নাচবে?

যাই হোক সুখী হোন আপনি, ভাল থাকুক আপনার সংসার। এই সুখে আমি কোনো দিন ব্যাঘাত ঘটাতে পারি নি, ঘটাবও না। বিয়েটাও আমি করব না। এত সোজা না আমাকে শাস্তি দেয়া। অনেক মেনেছি আর মানব না।

এবারে ছোট খালা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন। এত বুদ্ধমতি, প্রতিবাদী নারী তো আমি আর রাখতে পারব না বাবা।

তোমার সব কিছুতেই সমস্যা হলে আমরা কী করব?

বাপে এত ভাল প্রস্তাব দিল, তাতে হবে না। বিয়ে দিয়ে আমরা শাস্তি দিচ্ছি তো করতে হবেটা কী তোমার জন্যে শুনি?

আমি বললাম কিছুই করতে হবে না, আমি মায়ের কাছে চলে যাব।  মায়ের একটা চিঠি পেয়েছি গত পরশু। ছোট  মামার মাধ্যমে তিনি পাঠিয়েছেন।  লিখেছেন আমি রাজি থাকলে, আমাকে তার কাছে নিয়ে যাবেন।  ছোট মামার কাছে টাকা পাঠাবেন, মামা সব ব্যাবস্থা করে দেবেন।  

রুমের মধ্যে যেন বাজ পড়ল। আজকের পুরো ব্যাপারটাই নাটকীয়তায় মোড়ানো ছিল, তার শেষ যে এভাবে হবে কেউ স্বপ্নেও ভাবে নি।

খালা বিশ্বাস, অবিশ্বাসের দৃষ্টিতেআমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

এটা একটা ওপেন সিক্রেট যে ছোট মামার সাথে মায়ের মাঝে মাঝে যোগাযোগ হয়। মামার আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে পড়েছে। মা মামাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেন মাঝে মাঝে। কিন্তু মামা যে তলে তলে এতদূর করে ফেলেছেন তা স্বাভাবিক ভাবেই সবার চিন্তার বাইরে ছিল। 

সবচেয়ে বড় কথা আমি নিজেও এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলি নি। চুপচাপ খেলা দেখছিলাম, এত নাটকের সৃষ্টি করলাম।

আসলে এমন না করলে তো এই লোকটা এই বাড়িতে কখনও আসত না। আমি কখনোই জানতে পারতাম না, আমার হাসিটা অবিকল তার মতোই হয়েছে, আমার মতো তিনিও বাঁহাতি। তার চোখের পানি, আমার ভেতরের আগুনটাকে একটু হলেও তো শান্তি দিল। এতদিন যে জালায় জ্বালছিলাম কিছুটা হলেও তো তার আঁচ তার গায়েও লাগল।

লোকটা বলল—

—ওহ তোমার মায়ের সাথে যোগাযোগ হয় তাহলে?

আমি বললাম, নাহ প্রথম এই চিঠিটা দিয়েছেন। আমি গতকাল উত্তর পাঠিয়েছি। পৌঁছুতে হয়ত কিছুদিন সময় লাগবে। তারপর উনি প্রসেসিং শুরু করবে।

—কী লিখেছে চিঠিতে দেখানো যাবে? 

চিঠিটা আমার হাতের মুঠোতেই ছিল শুরু থেকেই ছিল, ইচ্ছে করেই নিয়ে এসেছিলাম, জানতাম এটার এখানে দরকার পড়বে।

বাড়িয়ে দিলাম ওনার দিকে চিঠিটা...

(চলবে....)

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন