শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২ , ২৭ শাওয়াল ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

নজরুলের অধিকাংশ নাটকই অন্তরালে, আমাদের মঞ্চেও অপ্রতুল

ফারুক হোসেন শিহাব আগস্ট ২৭, ২০১৯, ১৮:১৬:৪৮

6K
  • নজরুলের অধিকাংশ নাটকই অন্তরালে, আমাদের মঞ্চেও অপ্রতুল

শোষিত-নিপীড়িত মানুষের মনের অব্যক্ত কথন, অপ্রাপ্তি, ক্ষোভ-বঞ্চনাকে তুলে ধরতে দীপ্ত শিখার মতো জ্বলে উঠেছিল তাঁর কলম; বিপ্লবের হুঙ্কারে উচ্চারিত হয় তার কণ্ঠস্বর। সাম্প্রদায়িকতার বিষকে উড়িয়ে দিয়ে তুলে এনেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার অমৃত বাণী। বাঙালির জীবনে তিনি জাগিয়েছেন নতুনের স্বপ্ন, তুলেছেন নতুন জীবনতরঙ্গ। 

তিনি আর কেউ নন, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম; বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির কালজয়ী পথিকৃৎ। তিনি প্রেমের কবি, সাম্যের কবি ও বিদ্রোহের কবি,শুধু কবিই নয় তার লেখনী ধূমকেতুর মত আঘাত হেনে আমাদের জাগিয়ে তুলেছে বারংবার। রণাঙ্গনে, রঙ্গালয়ে, কারাগারে, চলচ্চিত্রে, নাটকে, রেডিওতে, মঞ্চে, কবিতায় এমনকি সাংবাদিকতাসহ সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রায় সকল শাখায় বিরল কালোত্তীর্ণ এক নাবিকের নাম কাজী নজরুল ইসলাম।

আমরা নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে সম্মান দিয়েছি সত্যি, কিন্তু তার সৃষ্টিভাণ্ডার নিয়ে যতটা কাজ করা দরকার তা কোনভাবেই করা হয়নি। তিনি যে বৈচিত্র্য এবং বিপুল রচনাসম্ভার নিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছিলেন তার অনেক কিছুই আজও লোকচক্ষুর অন্তরালে।

বাঙালি জাতিসত্তার গোড়া পত্তনে সংস্কৃতি শেকড়ের শিল্পমাধ্যম ছিল যাত্রা, পালা গান, কবি গান, লেটো গান, আখড়াই, হাফ-আখড়াই ইত্যাদি। এসবই মূলত আমাদের নাট্যধারার আদিরূপ। কিন্তু আধুনিক বাংলা নাটকের উদ্ভব হয়েছে ইংরেজি নাটকের আদর্শে। তবে আধুনিক নাটক বিনির্মাণে বহুলাংশেই আমাদের দেশজ ঐতিহ্য ও নিজস্বতার ছাপ রয়েছে। এই ভূখণ্ডে ইংরেজদের আগমন না ঘটলে হয়তো পুরোপুরি ভাবেই বাঙালির কৃষ্টি-সংস্কৃতির ভাবধারাতেই আমাদের নাটক গড়ে উঠতো।

মহাকবি মধুসূদনের হাতেই আধুনিক বাংলা নাটকের শিল্পিত ও সার্থক নাট্যরচনা প্রথম লক্ষণীয় হলেও কাজী নজরুল ইসলাম তার পূর্বসূরি মধুসূদন থেকে নয়, বরং আবহমান বাংলা নাটকের আবহ থেকেই তার নাটক রচনার অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন। বাংলাদেশে নাটকের সনাতন ঐতিহ্যের গভীরে প্রবেশ করে গণ-মানুষের মনস্তত্ব উপলব্ধি করে তিনি তার নিজস্ব ধারায় নাটক রচনার প্রয়াস পেয়েছেন।

বালক বয়সেই কবি নজরুল ছিলেন লেটো দলের সর্দার। দুর্ভাগ্যবশত, সেগুলো সব সংরক্ষিত হয়নি। সাময়িক প্রয়োজনেই তা রচিত হয়েছিল এবং নজরুলের অগোছালো স্বভাবের কারণে তা কখনো সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। যদিও সেসময় লেটোর ধারায় তিনি নতুনত্ব সৃষ্টি করেছিলেন। 

আর সে কারণেই ঐ বয়সেই তিনি ‘গোদা-কবি' অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ লেটো পালা রচয়িতা আখ্যায় ভূষিত হন। সে অভিজ্ঞতা তার সৃজনশীলতা বিকাশে একান্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নাট্যরচনায় তার কালজয়ী প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে সে সময়েই। লেটোর দলে থাকাকালে নজরুল যেসব পালা গান রচনা করেন, সে সবগুলোর হদিস এখন আর পাওয়া যায় না। যে কয়টির কথা জানা যায় তার মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য : ১. শকুনি বধ, ২. দাতা কর্ণ, ৩. চাষার সঙ্, ৪. ঠগ্পুরের সঙ্, ৫. মেঘনাদ বধ, ৬. কবি কালিদাস, ৭. আকবর বাদশাহ, ৮. রাজপুত্র। 

দুর্ভাগ্যবশত লেটোদলের জন্য লেখা সবগুলো পালাগানও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। যে কটা পাওয়া গেছে তার মধ্যে আছে : ১. আকবর বাদশা, ২. রাজপুত্রের সং, ৩. কবি কালিদাস, ৪. চাষার সং, ৫. ঠগপুরের সং, ৬. মেঘনাদ বধ, ৭. শকুনি বধ, ৮. দাতা কর্ণ, ৯. রাজা যুধিষ্ঠিরের সং, ১০. বিদ্যাভুতুম, ১১. বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ প্রভৃতি। ১৯৩১ সনে নজরুল আধুনিক রঙ্গমঞ্চের সাথে জড়িত হন। এ সময় তিনি কয়েকটি মঞ্চসফল পূর্ণাঙ্গ নাটক রচনা করেন। নাট্যকার আরিফুল হকের মতে, ‘আলেয়া এবং মধুমালা, এই পূর্ণাঙ্গ নাটক দুটি এ সময়েরই রচনা। ‘মধুমালা' কাজী নজরুল ইসলামের সর্বাধিক মঞ্চসফল নাটক। অনেকের মতে তিনি ছোট বড় মিলিয়ে একশোটিরও বেশি নাটক রচনা করেছিলেন। যার মধ্যে চল্লিশটি মাত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘নজরুল রচনাবলী'র চতুর্থ খণ্ডে নজরুলের আরও ২০টি নাটক, নাটিকা, গীতি-বিচিত্রায় তালিকা দেয়া হয়েছে। সেগুলো নিম্নরূপ : ১. ভূতের ভয়, ২. মধুমালা, ৩. জাগো সুন্দর চিরকিশোর, ৪. ঈদ, ৫. গুল-বাগিচা, ৬. অতনুর দেশ, ৭. বিদ্যাপতি, ৮. বিষ্ণুপ্রিয়া, ৯. বিজয়া, ১০. শ্রীমন্ত, ১১. পণ্ডিত মশায়ের ব্যাঘ্র শিকার, ১২. বাসন্তিকা, ১৩. ঈদুল ফেতর, ১৪. বিলাতী ঘোড়ার বাচ্চা, ১৫. বাঙালি ঘরে হিন্দি গান, ১৬. জন্মাষ্ঠমী, ১৭. প্ল্যানচেট, ১৮. সাপুড়ে, ১৯. বনের বেদে, ২০. লাইলি মজনু।

কেউ কেউ বলেছেন, শুধু তার রচিত পালা গানের সংখ্যাই শতাধিক। কেউ বলেছেন, তার বেতার ও গ্রামোফোন নাটক এবং একাঙ্কিকা-আলেখ্যর সংখ্যাও একশ'র কম নয়। যেহেতু এগুলো সংরক্ষিত নেই, তাই এ সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সত্যি কঠিন বিষয়। এ সম্পর্কে জনৈক নজরুল-গবেষকের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে কিছুটা ধারণা দেয়ার প্রয়াস পাব : ‘নজরুল ৮৪টি নাটক ও নাট্যকর্মের সাথে জড়িত ছিলেন। তার লেখা নাটক-নাটিকা-কমিক-নক্সা ৫৯টি এবং তার সঙ্গীত রয়েছে অপরের লেখা এমন নাটক ২৫টি।

একাধারে তিনি পালা, নাটক-নাটিকা, গীতি-নাট্য, গীতি-বিচিত্রা ইত্যাদি নাটকের বিভিন্ন কর্ম ও কলাকৌশল নিয়ে চর্চা করেছেন। বিভিন্ন, বিচিত্র বিষয়কে তিনি তার নাটকের বিষয় ও উপজীব্য করেছেন এবং সর্বোপরি তিনি শুধু নাটক লিখেছেন তাই নয়, একাধারে অভিনয়, নির্দেশনা, পরিচালনা, পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদিতেও সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং সবকিছুতেই তার নিজস্বতার ছাপ রয়েছেন। এমন অসাধারণ নজিরবিহীন প্রতিভার পরিচয় বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় আর কেউ নেই। তার রচিত নাটকের সুবিশাল জগত যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনি প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ। নাটকের কলা-রীতি, শিল্প-সৌকর্য ও চিরন্তন আবেদন সৃষ্টির ক্ষেত্রে অতটা সচেতন ছিলেন বলে মনে হয় না বলে অনেকেই মত দিয়েছেন। 

নাটক রচনার মাধ্যমেই মূলত তার বিস্ময়কর, সৃষ্টিশীল জীবনের যাত্রা শুরু। আর ‘যাত্রা’ রচনার মাধ্যমে কালজয়ী অভিযাত্রা শুরু হওয়া সেই মহাকবি তার পরবর্তী সৃষ্টিশীল জীবনে মঞ্চনাটক, রেকর্ড নাটক, বেতার নাটক ও সিনেমায় যে বিপুল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টিসম্ভার সংযোজন করেছেন তা আজো অনেকাংশে অনাবিষ্কৃত। নাটকের মধ্য দিয়ে দেশাত্মবোধের জাগরণ ও মহত্তর কল্যাণবোধের উত্তরণের জন্যে, উপেক্ষিত লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত আত্মবিস্মৃত ব্যক্তিকে চেতনা-সম্পন্ন করতে চেয়েছে নজরুল।

তার রচিত নাটক-নাটিকা ও নাট্যধর্মী রচনার সংখ্যাও কম নয়। বিচিত্র আঙ্গিক, বিচিত্র বিষয় নজরুল একাঙ্ক নাটক, পূর্ণাঙ্গ নাটক, কাব্যনাটক, শুধুমাত্র বাচ্চা মেয়েদের অভিনয় উপযোগী নাটক এমনকি রেডিওর জন্য অজস্র গীতিনাট্য লিখেছেন। বিশুদ্ধ রঙ্গ-কৌতুকের নাটকও লিখেছেন নজরুল।

মানুষ হিসেবে হিন্দু-মুসলমানে ফারাক করেননি তিনি। সেই দর্শন তার নাটকেও ফুটে উঠেছে। তিনি মুসলমানদের জন্য লিখেছেন ঈদের নাটক ‘ঈদ'। আবার সম্পূর্ণ হিন্দিতে হিন্দুদের জন্য নাটক লিখেছেন ‘জন্মাষ্টমী’। নজরুল বাংলা নাট্যরচনার ধারায় হাজার বছরের বাংলা নাট্যের সঙ্গীতময়তাকে আধুনিককালের প্রেক্ষাপটে দাঁড় করাতে পেরেছেন। কারণ নজরুলের নাটকের ভাষা, গীত ও কাব্যের যুগলবন্দীতে আবৃত।

তার নাট্য রচনার পরিণতি ও সমৃদ্ধি ঘটেছে নাট্যমঞ্চের সঙ্গে কবির সরাসরি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। তিনি বাঙালির রক্তে বিপ্লবের তেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যতদিন পৃথিবীতে একজন বীর বাঙালি বেঁচে থাকবেন ততদিন তার রক্তে, তার হৃদয়-স্পন্দনে প্রতিধ্বনিত হবে নজরুলের অনবদ্য বিদ্রোহী চেতনা। অথচ, আমরা এই কালোত্তীর্ণ কবির কর্মযজ্ঞকে নানাভাবে উপেক্ষা করেছি। তাকে আমরা কতটাই বা জানতে পেরেছি কিংবা জানার চেষ্টা করেছি? 

শুধুমাত্র নজরুলের জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকীর সময়টায় প্রতি বছরই টিভি চ্যানেল আর পত্রপত্রিকায় তাকে নিয়ে বিশেষ আয়োজনের হিড়িক পড়ে যায়। বাকিটা সময় তিনি পড়ে থাকেন অন্তরালে। তুলনামূলকভাবে নজরুল সঙ্গীতের যতটা চর্চা হচ্ছে তার নাটক বা অন্যসব সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে ততটা কাজ হচ্ছে কি? তার নাটক নিয়ে টেলিভিশনে যতখানি কাজ হয়েছে, সে অর্থে মঞ্চরূপ নাটকের সংখ্যা একবারের নগণ্য।

কবি নজরুল রচিত নাটকের সংখ্যা শতাধিক হলেও হাতেগোনা কয়েকটি নাটকই আমাদের কাছে পরিচিত। তার উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে- আলেয়া, মধুমালা, বিদ্যাপতি, পুতুলের বিয়ে, জাগো সুন্দর চির কিশোর, শ্রীমন্ত, বিষ্ণুপ্রিয়া, বনের বেদে, ঝিলিমিলি, সেতু–বন্ধ, ভূতের ভয় ইত্যাদি। 

এ পর্যন্ত যেসব নাটকের দল নজরুলের নাটক নিয়ে কাজ করেছেন তার মধ্যে ১৯৮৮ সালে সিরাজউদ্দৌলা থিয়েটার মঞ্চে আনে ‘রূপান্তর’ ও ‘অগ্নিগিরি’, ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রামের নাট্যদল তির্যক মঞ্চে আনে নজরুলের কবিতা অবলম্বনে ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’, একই দল ৯৯-এ মঞ্চে আনে ‘মধুমালা’। ওই বছর ‘ভূতের ভয়’ মঞ্চে তোলে হবিগঞ্জের দল নাট্যমেলা। ২০০১ সালে প্রতিবিম্ব থিয়েটার আনে নজরুলের ‘ভিক্ষে দাও’।

২০০২-এ বি.বাড়িয়ার দল সাহিত্য একাডেমি মঞ্চাঙ্গনে আনে ‘রাক্ষুসী, একই সময়ে লোক নাট্যদল টিএসসি মঞ্চে আনে ‘ঝিলমিল’। ২০০৮ সালে ‘মধুমালা’ মঞ্চে আনে লোক নাট্যদল সিদ্ধেশ্বরী। এ ছাড়াও নজরুলের ‘মানুষ’ ও ‘রাক্ষুসী’ মঞ্চে তোলে চাঁদপুরের দল অনন্য নাট্যগোষ্ঠী, বগুড়া থিয়েটার মঞ্চে আনে ‘দ্রোহ’, ।

কাজী নজরুল ইসলামের গীতিনাট্য ‘আলেয়া’ অবলম্বনে ২০১০ সালের ১৭ জুন প্রাঙ্গণেমোর মঞ্চে আনে নাটক ‘দ্রোহ প্রেম নারী’। রাজা মীনকেতু আর অন্য দেশের রানী জয়ন্তীকে নিয়েই গড়ে উঠেছে ‘দ্রোহ প্রেম নারী’ কাহিনি। ২০১১ সালে এসে ঢাকার দল জেনেসিস থিয়েটার মঞ্চে আনে নজরুলের জীবনীভিত্তিক নাটক ‘দামাল ছেলে নজরুল’।

নজরুলের ‘সাপুড়ে’ গল্প অবলম্বনে ২০১৫ সালের  ১৪ আগস্ট মহাকাল নাট্য সম্প্রদায় মঞ্চে আনে নতুন নাটক ‘নীলাখ্যান’। সর্বস্তরে নাটকটি ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। এখন পর্যন্ত নজরুল সাহিত্য নিয়ে যে সকল নাটক ঢাকার মঞ্চে এসেছে তার মধ্যে উপস্থাপনা, শিল্পবোধ ও জনপ্রিয়তার বিচারে সব চেয়ে বেশি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে এ নাটকটি। নজরুলের সাপুড়ে অবলম্বনে আনন জামান রচিত ‘নীলাখ্যান’ নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন ইউসুফ হাসান অর্ক। 

এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় নানাভাবে আমাদের মঞ্চে নজরুলের বেশকিছু শিশুকিশোর নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। কিন্তু তা একেবারেই অপ্রতুল এমনকি হাতেগোনা কয়েকটি প্রদর্শনীর পর নিয়মিত হতে পারেনি। তবে এরই মধ্যে নজরুলের নাটক মঞ্চে আনার বিষয়ে অনেক নাট্যদলই নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। 

এ বিষয়ে শিশু-কিশোর নাট্যান্দোলনের পথিকৃৎ ও ঋত্বিক নাট্যপ্রাণ লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘নজরুল বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির এমন মাধ্যম নেই, যেখানে তার কৃতিত্ব নেই। সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তার প্রভাবিত বিচরণ রয়েছে। তার সৃষ্টিসম্ভার বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নবতর যুগ প্রবর্তনের নিদর্শন।’

তিনি আরো বলেন, ‘কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, গানে যেমনি ছিল তার অসাধারণ শিল্পগভীরতা, তেমনি নাটকের ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা অতুলনীয়। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণে নজরুল নাট্যচর্চা হয়নি। টেলিভিশনে এবং শিশু-কিশোর নাটকে যতটা নজরুলচর্চা হয়েছে সে তুলনায় আমাদের মঞ্চে নজরুল অনেকটাই উপেক্ষিত রয়ে গেছেন। এ ব্যাপারে আমাদের আরও আন্তরিক হওয়া জরুরী। তা না হলে আমাদের জাতীয় কবির প্রতি অশ্রদ্ধা-অমর্যাদাই করা হবে।’ 

সাহিত্যনির্ভর নাট্যচর্চায়ও নজরুলের সাহিত্য যেন অনেকটা অবহেলিত। ঢাকার মঞ্চে সাহিত্যনির্ভর নাটকে নজরুল নিয়ে কিছু কাজ হলেও সেগুলো মান ও সংখ্যার বিচারে একেবারেই অপ্রতুল। সার্বিক অর্থে আমাদের নাট্যমঞ্চে নজরুল কমই চর্চিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন নাট্যসংগঠন নজরুলের কবিতা-গল্প অবলম্বনে নাটক মঞ্চে আনলেও তার রচিত মূল নাটকগুলোই রয়ে গেছে অন্তরালে।

নজরুলের সাপুড়ে অবলম্বনে ‘নীলাখ্যান’ নাটকটি নিয়ে নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক বলেন, ‘নাটকের কাহিনির প্রেক্ষাপট বেদে-বহর হলেও কবি নজরুল অন্তভ্রোতে এমন একটি সর্বজনীন বীজ ভাসিয়ে দিয়েছেন যা স্পষ্টতই গোটা মানবজাতির সর্বকালকে ছুঁয়ে যায়।’ 

নজরুলের নাটকের আরেক অভিনেতা-নির্দেশক রামিজ রাজু বলেন, ‘নজরুলের সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে শুরুতে একটু কঠিনই মনে হয়েছে পরে দলের সবাই বেশ সহযোগিতা করেছে। নাটকটি মঞ্চে আসার পর সবার প্রশংসা পেয়েছি। এই কাজটি করতে গিয়ে জানতে পেরেছি তাঁর সুবিশাল নাট্যভাণ্ডারের কথা। যা সেভাবে চর্চিতই হয়নি, এমনকি অনেক নাটক এখনো অনাবিষ্কৃত কিংবা যথার্থ সংরক্ষণই হয়নি। এটি সত্যি আপসোসের বিষয়।’ 

পরিশেষে বলবো, আমাদের নাট্য-ঐতিহ্যকে আরো প্রস্ফুটিত করতে হলে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্দীনদের মত সাহিত্যিক ও নাট্যকারদের নাটক এবং তাদের নাট্য সংশ্লিষ্ট অবদানকে রীতিমতো চর্চার পাশাপাশি আবিষ্কার, পুনরাবিষ্কার করা জরুরী। নজরুলকে জাতীয় কবির যে সম্মান দেয়া হয়েছে, সেটি শুধুই কাগজে-কলমে না রেখে অন্তত আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির চর্চায় যেন তাদের সুবিশাল সৃজনভাণ্ডারের প্রতিফলন ঘটে। এমন প্রত্যাশাই সকলের।

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন