শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২ , ২৭ শাওয়াল ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

বাংলা সাহিত্যে বহুমুখী প্রতিভার এক অনন্য পথিকৃৎ অন্নদাশঙ্কর রায়

ফারুক হোসেন শিহাব অক্টোবর ২৮, ২০১৯, ১৮:৫৫:২৯

6K
  • বাংলা সাহিত্যে বহুমুখী প্রতিভার এক অনন্য পথিকৃৎ অন্নদাশঙ্কর রায়

অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাংলা ছড়াসম্ভার বিষয়বৈচিত্র্যে তাৎপর্যপূর্ণ। তার প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথ এবং পরে বুদ্ধদেব বসুর অনুরোধে তিনি ছড়া লেখা শুরু করেন। একসময়ের গতানুগতিক ছড়া সাহিত্যকে তিনি উপেক্ষিত স্তর থেকে উন্নীত করেন অভিজাত সাহিত্যের শৈল্পিক স্তরে।

শুধু ছড়াকারই নয়, তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি ও চিন্তাবিদ। উনিশ শতকের বাঙালি রেনেসাঁ ঐতিহ্যের শেষ বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচনা করা হয় কীর্তিমান এই সাহিত্যজনকে। তিনি ছিলেন একজন বিনম্র-বিবেকী সাহিত্যশিল্পী। 

আজ ২৮ অক্টোবর অনন্য প্রতিভাধর এই সাহিত্যিকের ১৭তম প্রয়াণদিবস। ২০০২ সালের এইদিনে বাংলা সাহিত্যের কীর্তিমান এই ছড়াকার ও সাহিত্যজন না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। ১৯০৪ সালের ১৫ মার্চ ওড়িশার ঢেঙ্কানালে অন্নদাশঙ্কর রায়ের জন্ম। তার পূর্বপুরুষের আদি-নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কোতরং গ্রামে। 

কর্মসূত্রে তারা বসবাস শুরু করেন ওড়িশায়। জমিদার হিসেবে তার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন প্রজাহিতৈষী, মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী সাহিত্য-সংস্কৃতির অবিচল সমঝদার। পিতামহ শ্রীনাথ রায়, পিতা নিমাইচরণ রায় ও কাকা হরিশচন্দ্র রায়- এঁরা সবাই ছিলেন সাহিত্যরসিক এবং শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। অন্নদাশঙ্করের শৈশব কেটেছে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মিশ্র পরিবেশে। ১৯২১ সালে ঢেঙ্কানাল হাইস্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করেন এবং ভর্তি হন তৎকালীন পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কটক র‌্যাভেনশ কলেজে।

১৯২৩ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইএ পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৫ সালে তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। এমএ (ইংরেজিতে) শ্রেণিতে পড়াকালে ১৯২৭ সালে অন্নদাশঙ্কর রায় আইসিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে প্রশিক্ষণের জন্য চলে যান ইংল্যান্ডে। 

সেখানে তিনি লন্ডনের ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ’, ‘কিংস কলেজ’, ‘লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস’, ‘লন্ডন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ’-এ পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরই ফাঁকে ঘুরে বেড়ান সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ইটালি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ। ফলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটে তার সাহিত্যে। প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে ১৯২৯ সালে অন্নদাশঙ্কর রায় যোগ দেন মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে অ্যাসিসট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট পদে।

অবিভক্ত বঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, নদীয়া, ত্রিপুরা, মেদিনীপুর, হুগলি এবং হাওড়ায় তিনি নিযুক্ত ছিলেন কখনো শাসন বিভাগে, কখনো বিচার বিভাগে যথাক্রমে ম্যাজিস্ট্রেট ও জজ হিসেবে। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্বেচ্ছায় সরকারী চাকরি থেকে অবসর নেন।

অন্নদাশঙ্কর গদ্য ও পদ্য উভয় ক্ষেত্রেই ভূমিকা রেখেছেন। অন্নদাশঙ্করের সাহিত্যসৃষ্টি বৈচিত্র্যপূর্ণ। কেবল আঙ্গিকে নয়, ভাববৈচিত্র্যের তার রচনা কালোত্তীর্ণ। বিষয়বৈচিত্র্যে তার রচনা সমৃদ্ধ। ইতিহাস, সাহিত্যতত্ত্ব, দর্শন, সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমকালীন বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ তার গদ্যের বিষয়। দেশভাগ, দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তার লেখনী ছিল সোচ্চার। তার প্রবন্ধগুলা  অকল্পনা ও যুক্তি, প্রেম ও বিবেক, স্বদেশ ভাবনা, বিশ্বচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতার সমন্বয়ে আবৃত। তার সাহিত্যকর্ম বাংলাদেশে বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালির আত্মদান তার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। পরের বছর ১৯৫৩ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে এক ঐতিহাসিক ‘সাহিত্য মেলা’র আয়োজন করেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এই সাহিত্য মেলায় যোগ দেন কাজী মোতাহার হোসেন, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, শামসুর রাহমান, কায়সুল হকসহ আরো অনেকে।

অন্নদাশঙ্করের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে নিয়মিত ‘সাহিত্য সভা’ হতো এবং সেখানে সমাবেশ ঘটত আশ্রমের সাহিত্য রসিকদের। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি বহু পণ্ডিত অতিথি হয়ে আসতেন তার বাড়িতে। ষাট দশকের শেষ দিকে পারিবারিক কারণে বসবাস শুরু করেন কলকাতায় এসে এবং সেখানেই তিনি স্থায়ীভাবে থেকে যান।

বাংলা, ইংরেজি, ওড়িয়া, সংস্কৃত, হিন্দি-সব ভাষায় পারদর্শী হলেও বাংলাকেই তিনি সাহিত্যচর্চার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। বাড়ির ও কলেজের গ্রন্থাগারে তিনি সুযোগ পান ভারতীয় এবং ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হন। মাত্র তেরো বছর বয়সে অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত পত্রিকার গ্রাহক হন তিনি এবং ওই পত্রিকায় প্রকাশ করেন নিজের লেখা। প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ ছিল অন্নদাশঙ্করের লেখক হয়ে ওঠার প্রেরণা। সবুজপত্র পত্রিকার দুই প্রধান লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রমথ চৌধুরীর জীবনদর্শন ও শিল্পাদর্শ তার সাহিত্য-মানস গঠনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে। 

বাংলা ভাষায় তার প্রথম প্রকাশিত মৌলিক রচনার বিষয় ছিল নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা, যা ভারতী পত্রিকায় ছাপা হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের ওপর যে প্রবন্ধ লেখেন, তা রবীন্দ্রনাথকেও আলোড়িত করে। অন্নদাশঙ্করের প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ তারুণ্য, যা ১৯২৮ সালে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। 

দীর্ঘজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রায় সত্তর বছর ধরে প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, ছড়া, কবিতা, নাটক, পত্রসাহিত্য, আত্মজীবনীমূলক রচনা প্রভৃতি লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন তিনি। সব মিলিয়ে তার গ্রন্থের সংখ্যা বাংলায় ১২৩টি, ইংরেজিতে ৯টি এবং ওড়িয়া ভাষায় ৩টি। তার সাহিত্যসৃষ্টি বৈচিত্র্যপূর্ণ।

গদ্য ও পদ্য উভয় ক্ষেত্রেই ভূমিকা রেখেছেন তিনি। কেবল আঙ্গিকে নয়, ভাববৈচিত্র্যেও তার রচনা কালোত্তীর্ণ। বহুমুখী ভাবানুভূতি তার রচনার বিশেষত্ব। বিষয়বৈচিত্র্যে তার রচনা সমৃদ্ধ। ১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের বিদুষী তরুণী অ্যালিস ভার্জিনিয়া ওর্নডর্ফ ভারতীয় সঙ্গীত বিষয়ে গবেষণার জন্য ভারতে আসেন। সে সূত্রে অ্যালিসের সঙ্গে অন্নদাশঙ্করের পরিচয় ঘটে। ধীরে ধীরে দুজন ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে সেটি পরিণয়ে পরিণত হয়। সেই সময় ‘লীলাময় রায়’ ছদ্মনামে লিখতেন অন্নদাশঙ্কর। রবীন্দ্রনাথ অ্যালিসের নতুন নামকরণ করেন ‘লীলা রায়’।

অন্নদাশঙ্করের জীবনে লীলা রায়ের প্রভাব ব্যাপক। বহু ভাষায় পারদর্শী লীলা রায় নিজেও খ্যাতিলাভ করেন সাহিত্যিক এবং অনুবাদক হিসেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে এবং ১৯৯৬ সালে সরকারের অতিথি হিসেবে অন্নদাশঙ্কর দুইবার এ দেশে আসেন। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমির জন্মকাল ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি ছিলেন এর আজীবন সভাপতি ও পথিকৃৎ।

সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে জগত্তারিণী পুরস্কারে ভূষিত করে ১৯৭৯ সালে। তিনি ছিলেন সাহিত্য একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ফেলো। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে দেশিকোত্তম সম্মান প্রদান করে। বর্ধমান, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাকে প্রদান করে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৬২), আনন্দ পুরস্কার (দুইবার-১৯৮৩, ১৯৯৪), বিদ্যাসাগর পুরস্কার, শিরোমণি পুরস্কার (১৯৯৫), রবীন্দ্র পুরস্কার, নজরুল পুরস্কার, বাংলাদেশের জেবুন্নিসা পুরস্কার। ২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর কলকাতায় অন্তিমশ্বাস ত্যাগ করেন এই বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষটি।

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন