শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২ , ২৭ শাওয়াল ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

ক্ষণজন্মা সুকুমার রায় শিশু সাহিত্যের উজ্জ্বলতর পথিকৃৎ

ফারুক হোসেন শিহাব অক্টোবর ৩০, ২০১৯, ১৩:০১:২৫

18K
  • ক্ষণজন্মা সুকুমার রায় শিশু সাহিত্যের উজ্জ্বলতর পথিকৃৎ

সৃজন-মননে, অনন্য সাহিত্য বুননে তিনি গেঁথেছিলের দুর্লভ শিশুতোষ সাহিত্যসম্ভার। ‘রামগরুড়ের ছানা’ অথবা ‘পাগলা দাশু’, ‘আবোল তাবোল’ অথবা ‘ট্যাশ গরু’-এর মতো হৃদয়গ্রাহী শিশুসাহিত্যে আমাদের সাহিত্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। ঋদ্ধ করেছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের।

বলছি, বাংলা সাহিত্যের ক্ষণজন্মা লেখক ও শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের কথা। এই বাঙালি লেখক একাধারে, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, প্রাবন্ধিক ও নাট্যকার। খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ছিলেন সুকুমার রায়ের পুত্র । তিনি ভারতীয় সাহিত্যে ‘ননসেন্স রাইম’-এর প্রবর্তক।

আজ ৩০শে অক্টোবর অনন্য এই শিশু সাহিত্যিকের জন্মদিন। ১৮৮৭ সালের এইদিনে কলকাতার এক ব্রাহ্মণ পরিবারে সুকুমার রায় জন্মগ্রহণ করেন। তার আদি বাড়ি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার মসূয়া গ্রামে। তার মোট ২ ভাই ও ৩ বোন ছিলো, যাদের নাম যথাক্রমে- সুবিনয়, সুবিমল, সুখলতা,  পুণ্যলতা ও শান্তিলতা।

কলকাতার সিটি স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাশ করেন সুকুমার। আর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বি.এস.সি.(অনার্স) শেষ করেন। ১৯১১ সালে মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিনি বিলেতে যান। সেখানে আলোকচিত্র ও মুদ্রণ প্রযুক্তির ওপর পড়াশোনা করেন এবং কালক্রমে তিনি ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। 

তিনি ছিলেন বাংলা শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল রত্ন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ছেলে। সুকুমারের মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালির নবজাগরণের স্বর্ণযুগে। সাহিত্যিক হয়ে ওঠার পিছনে তার পরিবারের অবদান ছিলো প্রচুর। তার পারিবারিক পরিবেশ ছিল সাহিত্যানুরাগী, যা তার মধ্যকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়। পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন শিশুতোষ গল্প ও জনপ্রিয়-বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ। 

শোনা যায়, তিনি নাকি ছোটবেলা থেকেই মুখে মুখে নানা ধরণের ছড়া তৈরি করে ফেলতেন অনায়াসেই | এমনকি গান গাইতেন, নাটক করতেন আর কবিতাও লিখতেন। দেখতে দেখতে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সুকুমার রায়, অল্পবয়সী পাঠকদের মাঝে এক প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন এবং সেইসাথে প্রচুর মধ্যবয়সী পাঠকদের কাছেও সমান জনপ্রিয়তা লাভ করতে সক্ষম হন।

ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও সুকুমার রায়ের কবিতার অন্তত দু-চার লাইন অথবা তার ‘হযবরল’-র সঙ্গে পরিচয় ছিল না এমন লোকের সংখ্যা খুব কমই ছিল। সে তুলনায় এখনকার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা সুকুমার রায় ও তার লেখার সঙ্গে কতটা পরিচিত সেটি বলাটা অনেকটাই কঠিন। তবে একেবারে যে জানে না তা কিন্তু নয়। উদ্ভট খেয়াল রসের অফুরন্ত ভাণ্ডার সুকুমার রায় সবসময়ই প্রাসঙ্গিক।

সুকুমার রায়ের লেখায় রসবোধ ছিল প্রবল। তার সাহিত্য-সৃজনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ‘ছড়া’। শিশুদের জন্য লিখলেও তার লেখা ছড়া এতটাই প্রাণবন্ত যে, সেসব ছড়া বড়দের মুখে মুখেও গুরে ফিরতো। সুকুমার রায় তার ছড়ায় শব্দ নিয়ে খেলেছেন, যেমন খুশি তেমন গড়েছেন। তার ছড়া বা কবিতা যেমন বড়দের পড়ার বা বোঝার মতো ভারিক্কি নয়, তেমনি আবার কেবল ছোটদের জন্য লেখা হালকা শব্দ-গড়নেরও নয়।

তার কবিতা বা ছড়া যেমন সব বয়সের মানুষের কাছেই উপভোগ্য, গল্পের ব্যাপারে কিন্তু তা বলা যায় না। সুকুমার রায় খুবই সচেতনভাবে গল্পগুলো শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন। আর সেজন্যই গল্পগুলো আকারে ছোট এবং ভাষাও সহজ। সুকুমার রায় গল্পে গল্পে শিশুদেরকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখানোর চেষ্টা করেছেন। তবে তা ঈশপের গল্পের মতো করে নয়, গল্প বলার ভান করে উপদেশ দিয়েছেন। সুকুমার রায়ের 'হ য ব র ল' গল্পের বইটি খুব বিখ্যাত।

১৯১৩ সালে সুকুমার কলকাতাতে ফিরে আসেন। ইংল্যান্ডে পড়াকালীন উপেন্দ্রকিশোর জমি ক্রয় করে, উন্নত-মানের রঙিন হাফটোন ব্লক তৈরি ও মুদ্রণক্ষম একটি ছাপাখানা করার চিন্তা করেন। উপেন্দ্রকিশোর ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন, এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং মানসম্পন্ন ব্লক তৈরির একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মেসার্স ইউ. রয় এন্ড সন্স নামে ঐ প্রতিষ্ঠানের সাথে সুকুমার যুক্ত ছিলেন।

এসময় তিনি ছোটদের একটি মাসিক পত্রিকা ‘সন্দেশ’ প্রকাশনা শুরু করেন। সুকুমারের বিলেত থেকে ফেরার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার বাবা উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। উপেন্দ্রকিশোর জীবিত থাকতে সুকুমার লেখার সংখ্যা কম থাকলেও তার মৃত্যুর পর ‘সন্দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব সুকুমার নিজের কাঁধে তুলে নেন। শুরু হয় বাংলা শিশুসাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়। পিতার মৃত্যুর পর আট বছর ধরে তিনি ‘সন্দেশ’ ও পারিবারিক ছাপাখানা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন।

সুকুমার রায়ের স্বল্পস্থায়ী জীবনে তার প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। সন্দেশের সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে তার লেখা ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ আজও বাংলা শিশুসাহিত্যে মাইলফলক হয়ে আছে। তার বহুমুখী প্রতিভার অনন্য প্রকাশ তার অসাধারণ ননসেন্স ছড়াগুলোতে। তার প্রথম ও একমাত্র ননসেন্স ছড়ার বই আবোল-তাবোল শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে নিজস্ব জায়গার দাবিদার।প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়বার সময় তিনি ননসেন্স ক্লাব নামে একটি সংঘ গড়ে তুলেছিলেন।

এর মুখপাত্র ছিল সাড়ে বত্রিশ ভাজা নামের একটি পত্রিকা। সেখানেই তার আবোল-তাবোল ছড়ার চর্চা শুরু। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর মন্ডা ক্লাব (ইংরেজি ভাষা: Monday Club) নামে একই ধরণের আরেকটি ক্লাব খুলেছিলেন তিনি। মন্ডা ক্লাবের সাপ্তাহিক সমাবেশে সদস্যরা 'জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ' পর্যন্ত সব বিষয়েই আলোচনা করতেন।

ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের বিষয়ে কয়েকটি বক্তৃতাও দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তখনও নোবেল পুরস্কার পাননি। ইতিমধ্যে সুকুমার লেখচিত্রী/প্রচ্ছদশিল্পীরূপেও সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রযুক্তিবিদের পরিচয় মেলে, নতুন পদ্ধতিতে হাফটোন ব্লক তৈরি আর ইংল্যান্ডের কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রযুক্তি বিষয়ক রচনাগুলো থেকে। সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কার্য ছাড়াও সুকুমার ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারপন্থী গোষ্ঠীর এক তরুণ নেতা।

ব্রাহ্ম সমাজ, রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত একেশ্বরবাদী, অদ্বৈতে বিশ্বাসী হিন্দুধর্মের এক শাখা যারা ৭ম শতকের অদ্বৈতবাদী হিন্দু পুরাণ ঈশ-উপনিষদ মতাদর্শে বিশ্বাসী। সুকুমার রায় 'অতীতের কথা' নামক একটি কাব্য রচনা করেছিলেন, যা ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাসকে সরল ভাষায় ব্যক্ত করে - ছোটদের মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজের মতাদর্শের উপস্থাপনা করার লক্ষে এই কাব্যটি একটি পুস্তিকার আকারে প্রকাশ করা হয়।

তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলী হচ্ছে- ‘আবোল তাবোল’, ‘পাগলা দাশু’, ‘হেশোরাম হুশিয়ারের ডায়েরি’, ‘খাই-খাই’, ‘অবাক জলপান’, ‘লক্ষণের শক্তিশেল’, ‘ঝালাপালা ও অনান্য নাটক’, ‘হ য ব র ল’, ‘শব্দ কল্প দ্রুম’, ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’, ‘বহুরুপী’, ‘ভাষার অত্যাচার’।

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে কালাজ্বরে (লেইশ্মানিয়াসিস) আক্রান্ত হয়ে মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে সুকুমার রায় মৃত্যুবরণ করেন। সেই সময় এই রোগের কোনো চিকিৎসা ছিল না। মৃত্যুর সময় তিনি একমাত্র পুত্র সত্যজিৎ রায় এবং স্ত্রী সুপ্রভা রায়সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান। সত্যজিৎ রায় পরবর্তীতে উপমহাদেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালকরূপে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি মৃত্যুর ৫ বছর আগে ১৯৮৭ সালে পিতা সুকুমার রায়ের উপরে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রযোজনা করেন।

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন