শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২ , ২৭ শাওয়াল ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

‘চিতার আগুনে’ উপন্যাস নিয়ে কিছু কথা

কামাল সিদ্দিকী মে ১০, ২০১৭, ১৬:২৬:০৮

6K
  • ‘চিতার আগুনে’ উপন্যাস নিয়ে কিছু কথা

প্রাচ্যে যখন উপন্যাসের রমরমা বাজার, ড্রইংরুমে যখন উপন্যাসের চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ততার বিস্তৃতি মধ্যগগনে। সাহিত্যরসিকরা যখন উপন্যাসরসে সিক্ত হচ্ছেন তখনো আমাদের বাংলা সাহিত্যে এ শাখাটির জন্ম হয়নি। এরপর এক দমকা হাওয়ায় টেকচাঁদ ঠাকুর বা প্যারিদাসের হাত ধরে উপন্যাস নামক ভ্রুণটির এই সাহিত্য ভবনে আবির্ভাব। প্যারিদাসের সেই নবজাতকটির নাম ছিল ‘আলালের ঘরের দুলাল’ তখন এ শাখাটির রূপ, রস, আকৃতি বাংলা সাহিত্যে এতটাই অপরিচিত ছিল যে, সেটি ঠিক পূর্ণাঙ্গ হিসাবে বিকশিত হতে পারেনি। বরং পরবর্তীতে তাকে প্রথম প্রয়াস হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এটি যে ছিল উপন্যাসের প্রথম জননী তা বিজ্ঞজনেরা স্বীকার করে নিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে সৌভাগ্যের প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুমোদনও দিয়েছেন। তাই পরবর্তীতে বঙ্কিমের হাত ধরে শৈশব ছেড়ে কৈশর এমনকি যৌবনের মধ্যগগনে জাজ্বল্যমান হয়েছে। এভাবেই আমরা বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের সাথে পরিচিত হলাম। কাব্য, কবিতা, গীতিকাব্য, নাট্যচর্চা, সঙ্গীতকলার পরে ময়দানে হাজির হয়েও উপন্যাস এখন বাংলা সাহিত্যাকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল ধ্রুবতারা।

উপন্যাস পিছনে ফেলেছে সাহিত্যের অন্যান্য কলাকে। বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে উপন্যাসের আবেদন এখন ঈর্ষান্বিত পর্যায়ে। পরিসংখ্যানে হয়তো এটি শীর্ষে। এবারের একুশে গ্রন্থমেলায় সাদত আল মাহমুদের উপন্যাস ‘চিতার আগুনে’ প্রকাশিত হয়েছে। লেখকের এই লেখাটি পাঠক মহলে বেশ সাড়া ফেলেছে। কেন তা পাঠকরা লুফে নিয়েছেন তার বিস্তারিত আলোচনা করার খুব বেশি সুযোগ এ লেখায় নেই। লেখক উপন্যাসের ক্যানভাস হিসাবে বেছে নিয়েছেন সমাজের নানামুখী অসঙ্গতি আর সামাজিক অবিচারকে যেখানে গ্রামের সহজ-সরল এক মেয়ে যার নাম নন্দিনী। তার চরিত্র চিত্রনে লেখক বেশ মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। কাহিনির সূত্রপাত স্বাধীনতার আগে, যখন ভারতবর্ষ দ্বি-খণ্ডিত হলো। একখণ্ড মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান নামে বরাদ্দ পেল। আর তা হলো বিক্রমপুর মহকুমার লৌহজং থানার পশ্চাৎপদ গ্রাম পালগাঁও। গ্রামটিতে যারা বসবাস করেন তাদের বেশিরভাগই সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। আবার গ্রামটির জোতদার এবং মালিকানার দাবিদার এক কথিত মুসলমান। যিনি নামেই মুসলমান এবং বেশিরভাগ কারবারই ইসলাম বিরোধী শুরা আর সখা নিয়েই মানুষকে সহায়তার নামে সে নারীর ইজ্জত লুন্ঠনে সিদ্ধহস্ত। যার অপার ক্ষমতার ভয়ে নিপীড়িতরা সদা তটস্ত, যার নজরে পড়লে কন্যাসম মেয়েও লালসার শিকার হন সেই পাপাত্মাকে নিয়েই লেখক এক মহাকাব্যিক উপাখ্যান সাজিয়েছেন।

তার লালসার শিকার হয়ে গ্রামের সরলা মেয়ে নন্দিনী একদিন অবৈধ সন্তানের মা হয়। আবার তার ষড়যন্ত্রের কারণে নন্দিনীর ভালোবাসা হারিয়ে যায়। নন্দিনী তখন হয়ে উঠে সমাজের দুষ্টু গ্রহ। কিন্তু যার কারণে তার এই পরিণতি, সে রয়ে যায় ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। কেবল খেসারত দিতে হয় নন্দিনীকে। আমাদের সমাজে এমন ঘটনা বিরল নয়। আমাদের আশপাশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে এমন অসঙ্গতি, যা আমরা দেখেও দেখি না। যেটি যখন ছাপার অক্ষরে আমরা দেখতে পাই তখনই ঘটনার জন্য মনদ্রোহী হয়ে ওঠে। প্রতিবাদে ফেটে পড়ার ইচ্ছে হয়। কিন্তু... আমরা সুকৌশলে আমাদের দ্রোহিতাকে নির্মম হাতে হত্যা করি তাকে চালান করে দিয়ে নিজের মহত্ত্বকে ফলাও করতে সত্য-মিথ্যা জড়িয়ে দেবতা হয়ে ওঠার চেষ্টা করি। ‘চিতার আগুনে’ উপন্যাসের কুশীলবদের তেমনি প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পেয়েছি। তবে সমরেশের শেষ উপলদ্ধি সব অসহ্যকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়, তখন মনে হয় মনের গহিনে জমাটবাঁধা অন্ধকারকে ঠেলে কে যেন আলো জ্বালিয়ে সমরেশের কণ্ঠে  জানিয়ে দিলো, সতীত্ব দেহে নয় মনে।

কুসংস্কার অন্ধকার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে এবং ক্ষিপ্রতার সাথে লেখক অস্ত্রে শান দিয়েছেন। তিনি নতুন যুগের সূচনা করেছেন উপন্যাসের সাহিত্যে এমন দৃষ্টান্ত বিরলই বলতে হবে। সব যুগেই সত্যকে বরণ করে নেবার মতো সাহসীদের সংকট ছিল এবং আছে। আর তা যদি হয় সংস্কার বিশেষ করে প্রচলিত বিশ্বাসের ওপর তাহলে সুবিধাভোগী শ্রেণি কতটা কুটিল হয়ে উঠতে পারে তা লেখক বেশ দক্ষতার সাথেই চিত্রিত করেছেন। তালুকদার নামক সামাজিক কীটকে চিহ্নিত করা গেলেও তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ গড়ার মতো দুঃসাহসী মানুষের সংকট আমাদের নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। সমাজ যে শক্তের ভক্ত আর নরমের যম, এই মহা সত্যকে তিনি চাবুক মেরেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। তার পরেও সময় সাহসীদের অনুকর যা সমরেশের চরিত্রে প্রকাশ পেয়েছে। লেখক তার কারিশমা দিয়ে ছোট দিঘিকে মহাসমুদ্রে পরিণত করেছেন। আর তাতে অবগাহন করেছে উপন্যাস প্রেমিকের দল। তার এই প্রচেষ্টা আগামীর জন্য মাইল ফলক হয়ে থাকবে। অ্যাডর্ন পাবলিকেশন প্রকাশিত সেলিম রেজা সেন্টুর প্রচ্ছদে ঝকঝকে ছাপা এবং দামি মলাট ও কাগজে প্রকাশিত উপন্যাসটির দাম রাখা হয়েছে ২১০ টাকা। বইটির বহুল প্রচার মানেই সাহিত্যের ঝান্ডাটি আরো একবার সগৌরবে উড়বে এই প্রত্যাশা।

 

 

নিউজজি/এসএফ

 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন