শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২ , ২৭ শাওয়াল ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

আমার জীবনানন্দ

লুৎফর হাসান নভেম্বর ২, ২০১৭, ১৪:৪১:১৬

9K
  • আমার জীবনানন্দ

আমি এ ঘাসের বুকে শুয়ে থাকি – শালিখ নিয়েছে নিঙড়ায়ে

নরম হলুদ পায়ে এই ঘাস; এ সবুজ ঘাসের ভিতরে

সোঁদা ধুলো শুয়ে আছে- কাঁচের মতন পাখা এ ঘাসের গায়ে

ভেরেন্ডাফুলের নীল ভোমরারা বুলাতেছে – শাদা দুধ ঝরে

করবীর : কোন্‌ এক কিশোরী এসে ছিঁড়ে নিয়ে চ’লে গেছে ফুল,

তাই দুধ ঝরিতেছে করবীর ঘাসে–ঘাসে : নরম ব্যাকুল।

জীবনানন্দের সাথে আমার অথবা আমাদের নিয়মিত দেখা হয়, কথা হয়। কথা হতো আগেও। শৈশবে যখন তাঁর সাথে দেখা, তখন বুঝতে পারিনি এইখানে হেঁটে যাচ্ছেন জীবনানন্দ, ঐখানে জিরিয়ে নিচ্ছেন। আমাদের শৈশবে শিয়রের কাছে নদী ছিল, সে নদীর নাম ধানসিড়ি না হলেও ঝিনাই ছিল। সে নদীর পাড়ে শ্যাওড়া গাছে মধ্যরাতে পেঁচা আসতো, লটকন বনে ভর দুপুরে ঘু ঘু ডেকে উঠতো, কুঠিবাড়ির ঘন জঙ্গলে কিচিরমিচির শালিখের সাথে জমে উঠতো শ্যামা পাখির গান। ঘাসের ডগায় ডগায় শিশিরের চুপচাপ শুয়ে থাকা দেখতে দেখতে এখন মনে পড়ে, একদিন জীবনানন্দ সত্যিই ছিলেন আমাদের হেমন্ত শৈশবে। 

আমরা একদিন ঘোষণা দিয়ে বড় হয়ে গেলাম। বাইসাইকেল জীবন পার হতেই যে ট্রেন জীবনের বৃষ্টিপাত তার প্রায় সবটাজুড়েই জীবনানন্দ। দেখেশুনে জানালার পাশে বসে যেতাম। সামনে মুখোমুখি অবশ্যই বনলতা কাউকে খুঁজে পেতাম, অন্তত খুঁজে নিতাম বনলতাকে।

ইশ্বরদী পার হয়ে কিছুদূর যেতেই নাটোর স্টেশন। সামনে বসা মেয়েটা নেমে যেত অথবা নামত না। যে মেয়েটি নেমে যেত, ভাবতাম বনলতা বাড়ি যাচ্ছে বুঝি। যে মেয়েটি নামত না, সে সঙ্গী হতো আমাদের ঘিরে রাখা বাতাসের, চলন্ত গাছেদের, উড়ে যাওয়া পাখির ছায়াদের। ভাবতাম, বনলতা বেড়াতে যাচ্ছে কোথাও। কদিন বাদে ঠিক ফিরে আসবে। এইখানে বনলতাকে ফিরতেই হয়, ফিরতে হবেই। এ যে নাটোর স্টেশন। আমরা তখন সত্যিই যেন  জীবনানন্দের সঙ্গে ছিলাম। 

আমরা এইবার বড় হবার বদলে ঘোষণা দিয়ে ছোট হয়ে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তৃত গ্রন্থাগারে থরে থরে জীবনানন্দ। শেলফের এখানে সেখানে তাঁর সরব উঁকিঝুঁকি। কাচের দেয়ালে পশ্চিমের আকাশ। ফিনকি দিয়ে এক আঁজলা রোদ্দুরের বাড়াবাড়ি পড়ার টেবিলে। সেই রোদ্দুরের গায়ে নরম বাতাস, সেই বাতাসের রঙ ভীষণ সবুজ। এই রূপ সবুজাভ বাতাস আমাদের ধরে ধরে চেনালেন স্বয়ং জীবনানন্দই। 

তারপর আমাদের জীবনে মৌসুমি বর্ষার মতো প্রেম আসে, ঝমঝম করে আমাদের ভালোবাসার উৎসব শুরু হয়। আমরা কখন যেন কীভাবে ভাসতে থাকি। একদিন হঠাৎ ঝলমল করে রোদ উঠে যাবার মতো করে আমাদের সকল প্রেম বিচ্ছেদে রূপান্তরিত হয়। আমরা বিষাদের নামতা মুখস্থ করতে করতে দুজনের বিদায় সাজাই। শেষ দেখার আগে বুলি আওড়াই কুড়ি বছর বাদে আবার যদি দেখা হয় আমাদের। এই প্রেম আর এই বিষাদের দিক নির্দেশনা দিয়ে যান সেই জীবনানন্দই। 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন