মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ , ১ জিলকদ ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

নারী জাগরণের এক বিস্ময় মানবী বেগম রোকেয়া

ফারুক হোসেন শিহাব ডিসেম্বর ৯, ২০১৭, ১৬:৪৫:৪৩

9K
  • নারী জাগরণের এক বিস্ময় মানবী বেগম রোকেয়া

একজন দূরদর্শী সমাজ চিন্তক, সুসাহিত্যিক এবং মুসলিম নারী জাগরণে তিনি এক বিস্ময় মানবী। তাঁর সকল সৃষ্টিকর্মের আবেদন ও শক্তি এখনও সমানভাবে আন্দোলিত করে এ যুগের সচেতন নারী পুরুষকে। বলছি, বাঙালি নারী সমাজের মেধা-মনন এবং সুচিন্তিত মনোভাবের স্বপ্নদ্রষ্টা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কথা।

বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নেসা সাবের চৌধুরী। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি নারী জাগরণের অগ্রপথিক হিসেবে কাজ করে গেছেন। ‘মেয়েদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে যাহাতে তাহারা ভবিষ্যৎ জীবনে আদর্শ গৃহিনী, আদর্শ জননী এবং আদর্শ নারীরূপে পরিচিত হইতে পারে।’ ঊনবিংশ শতকে এমনি মানসিকতা বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন মুসলিম নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া।

যে সময় নারীর শিক্ষাগ্রহণ তো দূরের কথা ঘর থেকে বাহিরে নারীর বের হওয়াই ছিল দুষ্কর। সেখানে নারী সমাজকে শিক্ষার আলোয়ে আলোকিত করার অনবদ্য প্রয়াস রাখেন বেগম রোকেয়া। তৎকালীন মুসলিম সমাজ ব্যবস্থা অনুসারে রোকেয়া ও তার বোনদের বাইরে পড়াশুনা করতে পাঠানো হয়নি। তাদেরকে ঘরে আরবি ও উর্দু শেখানো হয়। বাংলা শেখা ছিল নিষিদ্ধ! তবে রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের আধুনিকমনস্ক ছিলেন। এমনি কঠোর বিধি-নিষেধের ভেতর রোকেয়া ও তাঁর ছোটবোন করিমুননেসাকে তিনি ঘরে গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শেখান।

১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট উর্দুভাষী ও বিপত্নীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন রোকেয়া। স্বামীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন মুক্তমনে চিন্তা করার সাহস ও সহযোগিতা। ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেন মৃত্যুবরণ করেন। অল্প বয়সে স্বামীর মৃত্যু হওয়ায় বেগম রোকেয়া সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েন। এ সময় তিনি সমাজ সেবা ও সমাজে নারী শিক্ষা বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তিনি পূর্বে জমানো অর্থে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গালর্স স্কুল নামে একটি মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯১০ সালে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি হলে স্কুল বন্ধ করে তিনি কলকাতায় চলে যান। ১৯১১ সালে স্কুলটি পুনরায় চালু করেন। মাত্র ৮ জন ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। পরে চার বছরের মধ্যে তা ৮৪ জন ছাত্রীতে দাঁড়ায়। ১৯৩০ সালে স্কুলটি হাইস্কুলে পরিণত হয়। ছাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া ও প্রাতিষ্ঠানিকসহ বিভিন্ন কারণে স্কুলটি বহুবার স্থান বদল করে। প্রায় দুই যুগ ধরে স্কুল পরিচালনায় তিনি তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন।

সে সময়ের ইতিহাস, পত্র-পত্রিকা ও বেগম রোকেয়ার লেখনি থেকে জানতে পারা যায়, কতটা কষ্ট, লাঞ্ছনা সহ্য করে তিনি ছাত্রী সংগ্রহ করেছিলেন। স্কুল পরিচালনা করতে গিয়ে বারবার তাঁকে বিরূপ সমালোচনা ও প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছিল। সবকিছুকে মোকাবিলা ও উপেক্ষা করেই স্কুলটিকে সে যুগে মুসলমান মেয়েদের শিক্ষালাভের অন্যতম প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। শৈশব থেকে মুসলমান নারীদের যে দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেছেন তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে নিজের স্বপ্ন ও আদর্শ বাস্তবায়ন করেন। স্কুল পরিচালনা ও পাঠদানে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বেগম রোকেয়া বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করতেন।

একই সঙ্গে তিনি কোলকাতার শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ ইংরেজ, বাঙালি, ব্রাহ্ম, খ্রিস্টান সব শ্রেণির মহিলাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাঁর উদ্যোমী চেতনা, শিক্ষার প্রতি অনুরাগ আর নিষ্ঠা সবাইকেই মুগ্ধ করে।

এ কারণেই সর্বমহলের সর্বাত্মক সহযোগিতা লাভ করেন তিনি। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯১৯ সালে সরকার কলকাতায় মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল স্থাপন করে। স্কুলের জন্য সরকারি সাহায্য এবং সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতা আদায় ছিল রোকেয়ার জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। শিক্ষা বিস্তারের জন্য দীর্ঘ প্রচেষ্টা ও প্রয়াসের ভেতর দিয়ে বাঙালির জীবন সংকটের বিভিন্ন দিক খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেন তিনি। যার ফলশ্রুতিতেই সাহিত্যাঙ্গনে বেগম রোকেয়ার সরব পদচারণা। ১৯০২ সালে তাঁর সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলা গল্প ‘পিপাসা’র মধ্য দিয়ে। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা ‘Sultana’s Dream’ এই রচনাকে নারীবাদী সাহিত্যে মাইল ফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বেগম রোকেয়ার সমগ্র সাহিত্য কর্মের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে সমাজের কুসংস্কার ও অবরোধ-প্রথার কুফল, নারীদের শিক্ষার পক্ষে তাঁর নিজস্ব মতামত নারীদের প্রতি সামাজিক অবমাননা এবং নারীর অধিকার ও নারী জাগরণ সম্পর্কে ধ্যান- ধারণা। বাল্যবিবাহ ও বহু বিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সবসময় সোচ্চার। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর দুরবস্থা এবং দৈহিক-মানসিক জড়তা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় যে শিক্ষা এ ধারণা তিনি তুলে ধরেন তীক্ষ্ম ভাষায় ও তির্যক ভঙ্গিতে।

সাহিত্যিক হিসেবে তৎকালীন যুগের প্রেক্ষাপটে রোকেয়া ছিলেন এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী, নবপ্রভা, মহিলা, ভারত মহিলা  আল-এসলাম, নওরোজ, মাহে নও, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, The Mussalman, Indian Ladies Magagine’ প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন।

বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গ সমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান তুলে ধরে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।

১৯১৬ সালে বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠা করেন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াত নে ইসলাম’ বা মুসলিম মহিলা সমিতি। তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার অন্যতম ক্ষেত্র এই মহিলা সমিতি। পরবর্তীতে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনে যেসব মহিলা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অনেকেই বেগম রোকেয়ার স্কুলে পড়াশুনা করেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করে তারই আদর্শে অনুপ্রাণিত হন।

১৯৩২ সালে ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া মৃত্যুবরণ করেন। আজ থেকে ১৩২বছর আগে জন্মেও তাঁর দূরদর্শী চিন্তা-চেতনা এখনো সমকালীন। এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও তিনিই নারী সমাজের পথ প্রদর্শক হয়ে আছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর স্বপ্ন নারীর জীবনে এক একটি সম্ভাবনা হয়ে ধরা দিচ্ছে। মহীয়সী এই আলোকবর্তিকার অনুপ্রেরণা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্ফূলিত হচ্ছে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। তাঁর কীর্তি চির অম্লান।

 

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন