শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২ , ২৭ শাওয়াল ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

সেই মেয়েটি (৫ম পর্ব)

পি. আর. প্ল্যাসিড সেপ্টেম্বর ৯, ২০২১, ১৭:৪৭:০৫

916
  • সেই মেয়েটি (৫ম পর্ব)

মনি একবার রান্নাঘরে যায় আবার আসে। এভাবে কয়েকবার আসা-যাওয়া করলেও কোনো কথা নেই তাদের মধ্যে। ভাস্কর অন্ধকার ভেদ করে মনির এই খাবার নিয়ে আসা-যাওয়া করা দেখে। খাবার আনা শেষ হলে শেষবার ভাস্করকে ডাকে, - এই আসো, খাবার খেয়ে নেও।

  এরমধ্যে মনি তাদের কুকুরটাকে মুক্ত করে দেয়। ছাড়া পেয়ে মনির পিছু পিছু তাদের কুকুরটাও মনির গা ধাক্কা দিয়ে বারান্দার ভিতর ঢুকে যায়। মনি কুকুরটাকে ধমক দিয়ে আবার বলে, - তুমি মনে হয় চ্যু খেয়ে নেশা হয়ে গেছো? 

  কুকুরটি দৌড়ে এসে ভাস্করের গায়ের গন্ধ নিতে থাকে আর গলা দিয়ে কোঁ কোঁ কোঁ শব্দ করে ভাস্করের সাথে খাতির করতে শুরু করে। ভাস্কর কুকুরকে এত ভয় পাবার কারণ, ছোট সময় তার ছোটো যে বোন শেলী তাকে কুকুরে কামড়ে ছিল। তখন তার পেটে নাভির চারপাশে চৌদ্দদিনে চৌদ্দটা ইনজেকশন নিতে হয়েছিল। তা দেখেই তার ভিতর ভয় কাজ করতে শুরু করে। সে সময় বলা হতো কুকুর কামড়ালে পেটে কুকুরের বাচ্চা হয় আর কুকুরের বাচ্চা বড় হয়ে ভিতরে কিলবিল করে এতে করে যাকে কামড়ায় সে মানুষটি মারা যায়। বোনকে এসব বলে ভয় দেখিয়ে ইনজেকশন দিলেও বোনের চেয়ে ভাস্করই ভয় পেতো বেশি। এরপর থেকে ভাস্কর কুকুর দেখলে সবসময় কুকুর থেকে দশহাত দূরে থাকার চেষ্টা করে। একবার মনে আছে এক কুকুর তার সামনে এসে ঘেউ ঘেউ করছিল, ভাস্কর সাহস করে গায়ের শক্তি দিয়ে কুকুরটিকে লাথি মেরেছিল। এতে উল্টো কুকুর তার পায়ে খাবলে ধরে ফলে যে ভয় ঢুকেছে তার মধ্যে এরপর দেশে আর কখনো সে কুকুরের সামনেই যায়নি। তাই মনিকে বলছে, এই তুমি আগে কুকুর সামলাও, আমি কুকুরকে খুব ভয় পাই।

 আরে তুমি এত ভয় পাও কেনো? তোমাকে নতুন দেখছে তাই এমন করছেও। দেখবে দিনের বেলা তোমাকে পেলে তোমার সাথে কত খেলা করে। নাতি দু'জনতো সারাক্ষণ এই কুকুর নিয়েই ব্যস্ত থাকে। দিনের বেলা দেখবে শনি তোমাকে কিছুই আর বলবে না। বলেই কুকুরের নাম ধরে ডাকে, এই শনি সর। আমাদের মেহমান তো।

  কি নাম বললে?

  আমার ছেলে এটাকে খুব ছোট সময় বাড়িতে এনেছিল। যেদিন নিয়ে এসেছিল সেদিন ছিল শনিবার, তাই ওর নাম রাখা হয়েছে শনি।

  মনি তার হাতে খাবারের কিছু বাটি নিয়ে শনিকে হাঁটু দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে বলে, তুমি ঘরে যাও তোমাকে আর কিছু বলবে না ও।  ভাস্কর তারপরেও ভয়ে ভয়ে শনির দিকে তাকায় আর ঘরের দিকে পা বাড়ায়। ঘরের দরজা পেরিয়ে একটু দৌড় দেবার মতো করে এগিয়ে ফিরে যায় তার আগের জায়গায়। মনি পাশে বসে ভাস্করের জন্য খাবার আলাদা করে দিয়ে নিজের প্লেটে খাবার নেয় আর বলে, তোমার কি মলি আর লিপিদির কথা মনে আছে?

   তোমার সাথে যে আরো কয়েকজন গারো মেয়ে ছিল তা মনে আছে কিন্তু তাদের নাম মনে নেই। আমি শুধু তোমার কথাই মনে রেখেছি। তোমাকে মনে রাখার কারণ হলো, সেসময় কলেজে পড়া একটা ছেলেকে তুমি বাবা ডাকতে। বিষয়টি আমার কাছে বেশ রহস্যজনক মনে হয়েছিল, তাই।

  তুমি এখনো সেকথা মনে রেখেছ? বলেই মনি তার মুখে কেমন এক রহস্যজনক হাসি টেনে আনে। ভাস্কর মনির হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, বিষয়টা আমার কাছে তখনই কেমন যেন একটু রহস্যজনক মনে হতো। আমি মনে করেছিলাম ওর সাথে তোমার প্রেমের সম্পর্ক বুঝি।

  তারপর?

  তারপর তো আর কখনো এ নিয়ে আমি ভাবিনি। একদিন তো তোমাকে নিয়ে ওর কাছে আমি গিয়েও ছিলাম।

  হ্যাঁ, নটরডেম কলেজের ভিতর হোস্টেলে থাকতো তখন।

সম্ভবত মার্টিন হলে ছিল ছেলেটি। তুমি ভুলে গেলেও আমি কিন্তু তা ভুলিনি।

    ওমা, তুমি বুঝি তাকে সন্দেহ করতে? ও তো সত্যি সত্যি আমার ধরম বাবা হয়। বলে খাবার মাখাতে শুরু করে। প্লেটে ভাত মাখিয়ে কিছুটা ভাত হাতে নিয়ে ভাস্করকে বলে, নেও, ভাত খাও আর কথা বলো। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব ঘুম পাইছে তোমার।

  আমি তোমার কোনো কিছুই ভুলিনি। তবে বনানী থেকে আসার পর আর কখনো এসব গুরুত্ব দিয়ে ভাবিনি। আমি না কোনো মেয়েদের প্রতি দুর্বল হলেও সেটা বেশিদিন আর মনে রাখি না। প্রেম-ট্রেম করা এসব আমার কাছে মনে হয় এক ধরনের সময়ের অপচয়। এসব নিয়ে পড়ে থাকলে কোনো কাজ করা যায় না। আমি সবসময় নতুন ধরনের কোনো না কোনো কাজ করতে পছন্দ করি।

  আমাদের সাথে যে গোল্লা না হাসনাবাদের দুই বোন ছিল, ওদের একজনের প্রতি তো তুমি বেশ দুর্বল ছিলে জানতাম।

  আরে না, ওখানে আমি কারো প্রতি দুর্বল ছিলাম না। তবে একজনকে অনেক ভালো লাগতো তা ঠিক। এমন তো নয় যে প্রেম করার জন্য অস্থির ছিলাম। তা কিন্তু নয়। সেই বয়সে ছেলে মেয়েরা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি একটু দুর্বল হতেই পারে। বলতে পারো সেই বয়সে ছেলেমেয়েদের বেলায় এটা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। বলেই আবার বলে, মেয়েদের প্রতি একটু আকৃষ্ট হওয়া ছেলেদের বেলায় খুব ন্যাচারাল, বরং এমনটা না হলে বুঝতে হবে সেটা অস্বাভাবিক।

    মনি এবার তার খাবার খাওয়াতে মনযোগ দেয়। মাঝখানে একটু সময়ের জন্য উঠে গিয়ে আলাদা একটা গ্লাসে করে তার জন্য চ্যু নিয়ে আসে। এরপর গ্লাসটি দুই ঠোঁটে চেপে ধরে কিছুসময় পর ঠোঁট থেকে সরিয়ে দুই ঠোঁট মুখের ভিতর নিয়ে আবার বাইরের দিকে দিয়ে পুরো দুই পাটি দাঁত বের করে বলে, আর কয়কেদিন রাখতে পারলে চ্যু-টা আরো কড়া হতো। বলেই টেবিলের উপর খাবার রাখা একটা বাটি গ্লাস দিয়ে সামনের দিকে ঠেলে জায়গা করে সেখানে গ্লাসটা রাখে। ভাস্কর বলতে থাকে, এটা হওয়া খুব স্বাভাবিক। না হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক। তবে আমার কাছে মেয়ে বিষয়টা, বাগানে ফুল ফুটে থাকার মতো মনে হয়। সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ সবারই হয়। অনেককে দেখবে বাগান থেকে ফুল ছিড়ে অর্থহীন ভাবে হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, একসময় তা আবার ছুড়ে ফেলে মাটিতে। কেউ না কেউ সেটাকে পায়ে দলিত করে। আমি মনে করি ফুল বাগানে থাকলেই অনেকের মনে আনন্দ জোগায়।

  তুমিতো বিয়েও করেছ, তাহলে মেয়েদের ফুলের সাথে তুলনা করে বাগানে রাখার কথা বলছো কেনো?

  দেখো, ফুল যেহেতু শোভা বৃদ্ধি করে তাই প্রয়োজনে বাজার থেকে আমি ফুল কিনে ঘরও সাজাই। সবসময় যে আবার ফুল বাগানে থেকে পচবে তাও কিন্তু নয়।

  আচ্ছা, তুমি দেশে আসো কতদিন পরপর?

  তা ঠিক নেই। বছরে তিন-চারবার আসা হয়ই, ঠিক নেই।

  বাব্বাহ্, আসতে কত টাকা খরচ হয় তোমার?

আসা-যাওয়া তারপর যে সময় আমি দেশে থাকি সেসময় সেখানে উপার্জন বন্ধ থাকে। তাছাড়া দেশে এসে খরচ করতে হয়। একবার আসলে আমার বলতে পারো তিনলাখ টাকার মতো খরচ হয়ে যায়। ভাস্কর রসিকতা করে প্রশ্ন করে, কেউ তো আমাকে এধরনের প্রশ্ন করে না। আমিও কখনো উত্তর দেইনা। তোমার প্রশ্ন শুনে মনে হচ্ছে তুমি আমার আসা যাওয়ার খরচ দিবে?

  হইছে, তোমার যা কথা। আমি তোমাকে কো-ত্থেকে দেবো ভাড়ার টাকা? আমার কি অত টাকা আছে?

  তাহলে জানতে চাইছো যে?

  তুমি কেমন কথা কউ? জানতে চাওয়াটা কি অন্যায়? আমার বড় মেয়ে একসময় বিদেশে আছিলো। ওর কাছে তো আমি সবসময় ওর ওখানকার গল্প শোনতাম। এই জন্য তোমারে জিগাইলাম।

  কোন দেশে ছিল?

  হংকং।

  আমি আগে দেশে আসতে যেতে হংকং ট্রানজিটে দু একবার রাত থেকেছি। আমার পরিচিত অনেক বাংলাদেশি আছে, ওখানে ব্যবসা করছে। তোমার মেয়ে কতসাল আগে ছিল? 

  কত আর হবে, তিন সাল আগে চলে এসেছে।

  দেশে ও এখন কি করে? বাসা কোথায়?

  ঢাকা বাড্ডাতে থাকে। জামাই ঢাকা চাকরি করে।

  ঢাকার বাড্ডাতে তো দেখেছি তোমাদের অনেক গারোরা থাকে। ওখানে একটা গির্জাও আছে। রবিবারদিন বাড্ডা গির্জায় গেলে মনে হয় আমি যেন গারোদের কোনো মিশনে এসেছি। রাস্তা দিয়ে খুব সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের দেখি তোমাদের আঞ্চলিক পোশাক পরে হাঁটছে।

  তোমার কি গারোদের খুব পছন্দ?

পছন্দ বলতে তুমি কি মিন করছো জানি না। তবে গারোদের আজকের অবস্থানের জন্য আমি মনে করি আমার জ্যাঠার সেই সময়কার কিছুটা হলেও ভূমিকা বা অবদান ছিল। এই জন্য গারোদের সমাজব্যবস্থা নিয়ে আমি কোথাও লিখতে চাই। আমার ইচ্ছে তাদের এই জীবন ব্যবস্থার উপর ডকুমেন্টারি তৈরী করে বহির্বিশ্বে প্রচার করতে।

  মনি তার কথার কতটা বুঝতে পারে, তা বোঝার জন্য ডকুমেন্টারির কথা বলেই চুপ করে সে ভাবে। কথা বলার পর ভাস্করের কাছে মনে হয়েছে  মনি তার কথা বুঝতে পারেনি। তাই কথা আর না বাড়িয়ে চুপ থাকে।

  ভাস্করের খাবার শেষ হলে মনি এবার ভাস্করের সামনে থেকে খালি প্লেট সরিয়ে নিয়ে বড় একটা বোলে পানি নিয়ে এসে বলে, এটাতে হাত ধুয়ে উঠো। পাশের ঘরে তোমার জন্য বিছানা রেডি করা আছে। ওখানে গিয়ে শুয়ে পড়ো। বলেই বলে, তুমি যাও, আমি আসছি। বিছানায় মশারি ঝুলিয়ে দিতে হবে। বলে সে খালি প্লেট নিয়ে রান্না ঘরে যায়। ভাস্কর বসে থাকে সেখানেই।

 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন