শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২ , ২০ শাওয়াল ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

সাধের নাগরদোলা

মেহেরুন নেছা রুমা মার্চ ২৫, ২০১৭, ১২:২৪:৪৫

6K
  • সাধের নাগরদোলা

খাটের পাশেই লাগোয়া স্টিলের আলমারি। তাই কটকট শব্দটা বড় অসহ্য লাগছে। আলমারি খোলার শব্দ যাতে কানে প্রবেশ না করে সেই ব্যর্থ চেষ্টায় মাথার বালিশ কানে চেপে ধরছি। ওহ! অসহ্য! গলার আওয়াজটাকে একটু বাড়িয়ে বললাম- এই হচ্ছেটা কী শুনি? ছুটির দিনে কি একটু শান্তিতে ঘুমাতে দিবে?

বেশ আহ্লাদের সুরে রেমি বলে, ‘শুভ নববর্ষ’ মৌমাছি।

হুম, শুভ নববর্ষ। কিন্তু মৌমাছি কেন বললে তা তো বুঝলাম না।

রেমি বলল, অতসব বুঝে কাজ নেই।

মনে মনে ভাবলাম আজ রেমির মনটা ভালো। তাই এই সাতসকালে এমন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে। যাই হোক, শব্দটা আমার মনে ধরেছে। এক ঝলক শিহরণের বাতাস বয়ে গেল মনে।

রেমি তাড়া দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি উঠে তৈরি হও।

তৈরি হব মানে?

মানে আমরা বাইরে যাব না? আজ পহেলা বৈশাখ। ভুলে গেছ নাকি?

তা ভুলিনি। কিন্তু এত্ত ভোরে! অন্যদিন তো তুমি এ সময় পাশ ফিরেও শোও না। আর আজ কিনা সেজে গুজে তৈরি।

দেখো কথা বাড়িও না, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

এর মধ্যেই লাল টুকটুকে পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা পরে আমার পাঁচ বছরের ছেলে এসে আমার পিঠের ওপর বসল।

আরে বাবা তোমাকে তো দারুণ লাগছে!

থ্যাংকস, পাপা।

ছেলেকে ধমক দিয়ে রেমি বলে উঠল, অ্যাঞ্জেল আজ না তোমাকে বলেছি পাপাকে বাবা, আর আমাকে মা বলে ডাকতে?

সরি মম, আই মিন -দুঃখিত মা, আর ভুল হবে না।

ছেলে আর রেমির কথাবার্তা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম আমি। তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিছানা ছেড়ে নিজেকে ওদের দলে ভেড়াতে চেষ্টা করলাম। খাবার টেবিলের কাছে এসে বরাবরের মতোই নাস্তার কোনো আয়োজন চোখে পড়ল না। রেমিকে বললাম, আজ যেহেতু সকালবেলা উঠেছ কিছু তো একটা বানাতে পারতে ।

এ কী বলছ তুমি? ঘরে কেন নাস্তা বানাব। আমরা এখন রমনায় গিয়ে পান্তা ইলিশ খাব না? আর এখনো আমার চোখে ঘুম জড়িয়ে আছে।

তা তো থাকবেই। সারা রাত বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখবে, সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমাবে, আর আমি প্রতিদিন অফিসে যেয়ে নাস্তার অর্ডার দিই। যেন কোনো ব্যাচেলর অফিসার আমি।

দেখ এখন এত কথা শোনার সময় নাই। বলতে বলতে রেমি আলমারি থেকে লালপেড়ে সাদা শাড়িটা বের করল। আয়নার সামনে গায়ের সাথে শাড়িটা ধরে মুখে ভেংচি কেটে বলে, এ শাড়িটার চেয়ে ওটাই আনলে ভালো হতো। একেবারে আনকমন ডিজাইন ছিল। ওমন একটা শাড়ি খুশি পরেছিল একদিন।

খুশি আবার কে?

আরে ওই যে স্টার প্লাস-এর সিরিয়ালের নায়িকা।

ওহ আচ্ছা। তো নিলে না কেন খুশির শাড়িটা?

নিব কিভাবে, ওটার দাম শুনেই তো তুমি বেরিয়ে গেলে দোকান থেকে।

তুমি তো আমার বেয়াইন নও, আমার বৌ। তুমি জানো না আমার মাসে কত টাকা উপার্জন? এমন যেকোনো উৎসবেই তোমার শাড়ি গহনা কত কী লাগে। আমার কী এত সাধ্য আছে ? এই শাড়িটা যে কিনে দিলাম তার জন্যই আমার এ মাসে দুপরে শুধু রুটি আর সবজি খেয়ে থাকতে হবে।

তা আমি কী করব ? তুমি তোমার উপার্জন বাড়াতে পারো না তার দায় কি আমার ? একটা শাড়ি কিনে দিয়েছ বলে তার খোটা দিতে থাকবে এ আমি সহ্য করব না। যাবই না আজ কোথাও।

বলেই শাড়িটা ছুড়ে মেরে বিছানায় বসে পড়ল। বুঝতে পারলাম আজ আর কী কী ঘটবে। আমার মৌনতা রেমিকে আরো উত্তেজিত করল। শোক সীমা ছাপিয়ে উপচে পড়ল। জীবনে তার সব আশাই অপূর্ণ রয়ে গেল।

আমি বললাম, দেখো রেমি তুমি তো সবই জানতে। একই কথা বারবার বলে কেন নিজে কষ্ট পাচ্ছ, আর আমাকেও কষ্ট দিচ্ছ ?

আমি ? আমি তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি ? রেগেমেগে আগুন হয়ে এবার হাতের কাছে যা যা পেল সব এদিক-ওদিক ছুড়ে মারল। তারপর রান্নাঘরে যেয়ে হাড়ি-পাতিল ধরল। ওগুলোতে শব্দ বেশি হয় বলে হয়তোবা রেমির রাগের বহিঃপ্রকাশটা বেশি ঘটাতে পারে। তার সাথে জুড়ে দিলো নাকে কান্না। ছেলেটা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, পাপা, (সরি বাবা) আমরা কখন যাব মেলায়? মম (ধ্যাৎ) মা আমাকে বলছে ঢোল বাঁশি এসব কিনে দিবে। নাগর দোলায় চড়ব না পাপা? (ও্হ শীট, বাংলা বলা কত কষ্ট !)

বাবা রে, কী আর হবে মেলায় গিয়ে! তোর মা এই যে ঘরের মধ্যে বাদ্য বাজাচ্ছে সেটাই হলো ঢোল আর ডুগডুগি, অহেতুক যে কান্নাকাটি করছে সেটা তার বাঁশি, আর আমার বাঁশিটার বাঁশ ফেটে গেছে। তাই কোনো আওয়াজ হয় না, শুধু বাতাসের মতো দীর্ঘশ্বাস বের হয়। সাত বছর ধরে আমাকে যে আঙুলের ইশারায় ঘুরাচ্ছে এটাই হলো নাগরদোলা। এখন পারিস তো আমার পিঠের ওপর উঠে বস। এ ছাড়া আমার আর কিছু করার নাই।

নিউজজি/এসএফ/ এমকে

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন