মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫, ২৭ কার্তিক ১৪৩২ , ২০ জুমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

সাহিত্য
  >
গল্প

দহন...(পর্ব-২)

নাবিলা শারমিন এপ্রিল ২৩, ২০২৫, ১৪:৪৯:১৯

461
  • নাবিলা শারমিন

ছোটবেলাটা আমার একা একাই কেটেছে। তেমন কোনো বন্ধু ছিল না। কেও চাইত না তাদের বাচ্চা আমার সাথে খেলুক মিশুক। আমার প্রতি সবার আচরণ দেখে বাচ্চাগুলোও বুঝত যে এ ঠিক আমাদের মতো না, কিছু একটা সমস্যা আছে। এমনকি আমার আত্মীয়স্বজনও আমার তাদের বাসায় বেড়াতে যাওয়াটা পছন্দ করত না। কারণ আমার মা দুশ্চরিত্রা। সে রক্ত আমার গায়েও আছে। সবারই তো নিজের বাচ্চা নিয়ে ভয় আছে, আজেবাজে সঙ্গে পড়ে খারাপ না হয়ে যায়।

আমারও কোথাও যেতে মন টানত না তেমন। শুধু সমুদ্র দেখতে ইচ্ছে করত। দুর্নিবার ইচ্ছে...

যখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি, আমাদের স্কুল থেকে ঠিক করল কুয়াকাটা যাবে, দুদিনের জন্য। আমার বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়ে গেল। বাঁচিমরি যেতেই হবে আমাকে, যে কোনো উপায়ে।

নানির কাছে ছুটে গেলাম তীর খাওয়া হরিণীর মতো করে। আমার অবস্থা দেখে তিনি হেসেই খুন। কথা দিলেন গম বিক্রির পুরো টাকা আমাকে দেবেন, যা ইচ্ছে আমি কিনতে পারব, যা ইচ্ছে খেতে পারব ওখানে গিয়ে।

রাতে স্বপ্ন দেখতাম একরাশ জলরাশির মধ্যে আমি দাঁড়িয়ে আছি। অনেকটা পুকুরের মতো, অনেক বড় পুকুর। আমার হাতে তুলোর একটা কুকুর ছানা।  আমি ভাবছি এটা পানিতে ফেলা যাবে না, ফেললে নষ্ট হয়ে যাবে। স্বপ্নটা আমি এখনও মাঝে মাঝে দেখি,  খুব বিরক্ত লাগে আমার।

যাই হোক শেষপর্যন্ত আর যাওয়া হয়নি সমুদ্র দেখতে। স্কুলের স্যাররা বললেন এতগুলো মেয়ে নিয়ে এতদূরে দুদিনের জন্য যাওয়াটা রিস্ক। কে নেবে দায়িত্ব?

তাছাড়া সবার বাসা থেকে রাজিও হচ্ছে না এত দূরে পাঠাতে, টাকারও সমস্যা অনেকের। এর চেয়ে ভাল কারও মন খারাপ না করে স্কুলের ভিতরেই পিকনিক করা হোক। গান বাজানো হবে, সবাই ভাল শাড়ি পরে আসবে, কুইজ আর লটারি প্রতিযোগিতাও হবে। আর কী চাই।

আমি যাই নি, নানি অনেক বলেছিলেন যেতে। আমি ঘরে শুয়েছিলাম সারাদিন।

হঠাৎ হঠাৎ বিয়ে বাঁধত পরিবারের কারো। নানি পিঠা, মোয়া, নাড়ু বানিয়ে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন বিয়ে খেতে। এলাহি কাণ্ড সব। কনে তো নয় যেন কোনো রাজকুমারী। কী তার আদর, কী তার যত্ন। সারাবাড়ি মরিচবাতির আলোয় ভরা, আলপনা আঁকা, বারবার কনের মা চোখ মুছছে।

আমিও কল্পনার রাজ্যে ভেসে যেতাম। আমার জন্যও এমনি করে আল্পনা আঁকা হয়েছে, বাতি জ্বালানো হয়েছে। কিন্তু চোখ মোছার মতো কাউকে কল্পনাতেও খুঁজে পেতাম না।  শেষমেশ নিজেই চোখ মুছতাম, কেউ সে জল মুছিয়ে দিত না,  কেউ সে জলের খোঁজ রাখে নি কোনো দিন।

বিয়ে বাড়িতে আমাকে কোনায় কোনায় লুকিয়ে থাকতে হত। না পারতাম আমি গেট ধরতে, না পারতাম বরের খাওয়ার পর হাত ধোওয়াতে। কারণ আমাকে নিয়ে যদি  বর পক্ষের কেও প্রশ্ন করে বসে আমি কে, কার মেয়ে। আমার মায়ের ব্যাপারটা আর ঢাকা থাকবে  না।

যাই হোক, ব্রিজের নিচে যে পাগলটার গায়ে পোকা হয়েছে, কুকুরকে জরিয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকে সেও তো মানুষ তার চেয়ে তো অন্তত ভাল আছি আমি, এটাই আমার বেঁচে থাকার মন্ত্র।

ছোটখালার বাড়িতে খুব তাড়াতাড়িই একটা বিয়ে বাঁধবে, মিমের বিয়ে। আমাকে কেউ বলে নি, আমি বুঝতে পারছি। কিছুদিন আগেই ওকে নিয়ে বাজে একটা কাহিনি হয়েছে। সেটাকে আমার বুদ্ধিমতি খালা খুব তড়িঘড়ি করে ধামাচাপা দিয়েছেন। কাকপক্ষীও যাতে টের না পায় এমন ভাবে। তবুও ঘটনা কিছুটা ছড়িয়েছে, যদিও সবাই ভাবছে গুজবও হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে এই গুজবের কিছু প্রমাণ আছে। কারণ এরা আমার প্রতি এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে, এ ধরনের কাজেও আমার সাহায্যের দরকার হয়।

খালা মিমের বিয়ে দিতে চাইছেন আবির ভাইয়ের সাথে। আবির ভাই মিমের বড় ভাইয়ের বন্ধু। মাঝে মাঝেই আসেন এ বাড়িতে। তার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে।

তিনি দেখতে শ্যামলা, লম্বা আর সুঠাম দেহ। চুলগুলো কোকরানো। ইদানিং এ বাড়ির কেউ চায় না, আমি আবিড় ভাইয়ের সামনে যাই। কারণ তার সাথে মিমের বিয়ে হবে। আর আমার বাকি কিছু চিন্তা না করে, যদি মিমকে আর আমাকে পাশাপাশি দাঁড় করানো হয় যে কোন পুরুষ আমাকেই বেছে নেবে নিঃসংশয়ে।

বিধাতা এই একটা জিনিসে আমাকে এগিয়ে রেখেছেন। আমাকে হাজারো তাচ্ছিল্য করেও শেষে একটা কথা বলতে সবাই বাধ্য, “হ্যাঁ সুন্দরী হয়েছে অনেক, মায়ের চেয়েও বেশি”।

সেদিন ভাইয়া, ভাবি, মিম, আবির ভাই বাইরে যাচ্ছিল একসাথে সিনেমা দেখতে। অনেক সেজেছে মিম, মুখভরতি লাল, গোলাপি রঙের সমাহার। আমি গোসল করে বেরিয়ে কাপড় মেলতে যাব তখনি দরজার কাছে দেখা হয়ে গেল ওদের সাথে।

আমাকে দেখে আবির ভাইয়ের চোখের সেই মুগ্ধতা, কারো চোখ এড়ায় নি। মিমের চোখের দৃষ্টির হিংসার সেই বিষ মনে হচ্ছিল আমার স্নিগ্ধতাটুকুকে জ্বালিয়ে দেবে।

মনে মনে হাসলাম আমি। হায়রে মেয়ে, এটুকুও তোর সহ্য হচ্ছে না, একটাবার ভেবে দেখেছিস আমি কিভাবে তাহলে সহ্য করছি দিনের পর দিন?

আবির ভাই আসলেই চা করতে বলে আমাকে৷ মাঝে মাঝে চা করা শেষ হলে খালা মিমকে বলে চা টা আবিরকে দিয়ে আয়। আবির ভাই আবার ডাক দেয় আমায়, “চিনির দাম কি খুব বেশি নাকি রে? চিনি তো দিস ই নি। চিনি দিয়ে যা তো।”

আমি জানি আমি চিনি ঠিকই দিয়েছি, খালাও জানে।

উনিও আসেন পেছন পেছন, আবির ভাইয়ের মা কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতে। ওনার সামনেই আমি কোনো একটা ছুতোয়, ইচ্ছে করে আমার সেই হৃদয় কাঁপানো হালকা হাসিটা দিই।

এভাবেই ইঁদুর বেড়াল খেলা চলতে থাকে। খালা ভাবেন উনি নজরদারি করে সব খবর পেয়ে গেছেন, সব খবর উনি পান নি।

উনি জানেন না আমার কাছে একটা যক্ষের ধন আছে।

কেউ জানে না, রোজ রাতে আমার ট্রাংক থেকে ওটাকে বের করে আমি চুমু খাই, ওটা ধরে কাঁদি, আবার কাপড়ে পেঁচিয়ে জায়গামত রেখে দিই...

(চলবে)

নিউজজি/নাসি 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন