শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২ , ২০ শাওয়াল ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

‘পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া’

নাজমুস সাকিব রহমান আগস্ট ৬, ২০১৭, ১২:৩৩:৪৪

6K
  • ‘পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া’

তেত্রিশোর্ধ বাবু ভাই বন্ধু-বান্ধবের বিয়ে খেয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু মানুষের কোনো সুখই দীর্ঘদিন থাকে না। তার ক্ষেত্রেই বা থাকবে কেন? আর, করব না- করব না বলেও পুরুষ মানুষ যে কাজটা করে, সেটা হল বিয়ে। শেষ পর্যন্ত তিনিও জুন মাসের তেরো তারিখ, রোজ সোমবার বিয়ে করে ফেললেন। ভাবি কেজি স্কুলের শিক্ষিকা। অপূর্ব সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, ঠিক তা-ই।

এই বিয়ের তৃতীয় দিবসে বাবু ভাইয়ের মা কানাডায় চলে যান। শুনেছি, চাচী সেখানে দু'মাস থাকবেন। এই পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার কারণ, আমি তাদের প্রতিবেশী। চাচাকে দেখে মুগ্ধ হবার সুযোগ না পেলেও, চাচী যেভাবে পুত্র ও পুত্র বধুকে কাছাকাছি আসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন—তা দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম।

বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীকে কোথাও না কোথাও বেড়াতে যেতে হয়। যেকোনো জিনিস কিছুদিন চর্চা করলে একসময় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। হানিমুনের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। নিহি ভাবি যখন তার স্বামীকে বললেন, ‘এই বাবু, আমরা হানিমুনে কোথায় যাচ্ছি?’

বাবু ভাই বললেন, ‘নিহি শোন, বাসাটা পুরো খালি। কেউ নেই। তুমি চাইলে আমরা হানিমুনটা বাসাতেই সেরে ফেলতে পারি।’

আসলেই তিনি অলস মানুষ। আমি একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনার পেশা কি?’

তিনি বললেন, ‘আমার প্রধান পেশা অলসতা।’

‘অপ্রধান পেশা?’

‘বিজ্ঞাপন লেখা।’

স্বামী-স্ত্রীর একজন উত্তর মেরু হলে অন্যজন দক্ষিণ মেরু হবেন— এটাই স্বাভাবিক। এ কারণেই স্ত্রীর প্রবল আপত্তির মুখে বাবু ভাইকে পরদিনই কক্সবাজার-বান্দর বানের উদ্দেশ্যে বাসে উঠতে হয়েছে।

তারা সেখানে এক সপ্তাহ ছিলেন।

 

শনিবার বিকেল বেলা পাড়ার চায়ের দোকানে গিয়েছি। হঠাৎ দেখলাম, দোকানের বাইরে যে সব বেঞ্চি পাতা আছে, তার একটিতে বাবু ভাই পা ছড়িয়ে বসে আছেন। তাকে দূর থেকে দেখে মনে হল, নিজের সাথে কথা বলছেন। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম—ঘটনা তা না। উনি আসলে গলা চেপে রেখে গান গাইছেন। নচিকেতার সে-ই বিখ্যাত গান। পুরুষ মানুষ দু'প্রকার, জীবিত-বিবাহিত।

যে লোক সারাজীবন গলা খুলে জেমসের গান গেয়েছেন, তাকে এমন ফিসফিস করে নচিকেতার গান গাইতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, আপনার বলিউডি গলার এই অবস্থা কেনো?’

বাবু ভাই চোখে-মুখে বিষাদ এনে উত্তর দিলেন, ‘আর বলিস না। তোর ভাবি তো পেশায় শিক্ষিকা। সবকিছুতেই ভুল ধরে।’

আমি বললাম, ‘পরীক্ষার খাতা দেখলে এরকম অভ্যাস হয়।’

‘আরে শোন, সেদিন গান করছি—এমন সময় নিহি এসে বলল, ওই দেখা যায় তালগাছ ছাড়াও আরও এক ধরণের তাল আছে। অথচ তোমার কণ্ঠে তার কোনো অস্তিত্বই নেই।’

‘ভাবি বোধ হয় জানেন না, আপনি বেতালের তালিকাভুক্ত শিল্পী। তা-ও এ গ্রেডের।’

আমার কাছ থেকে এমন সান্ত্বনা পেয়ে বাবু ভাই ব্লাঙ্ক লুক দিলেন। যদিও পুরুষ মানুষের শুন্য দৃষ্টি দেখে কিছু বোঝা যায় না। বাবু ভাই তারপর বাসার দিকে চলে গেলেন। ঠিক তখনই আমার মনে হল—এক সপ্তাহের হানিমুনে নিহি ভাবি তার স্বামীকে সঠিকভাবে চিনে নিয়েছেন।

এরপর ঘটনার দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে।

কয়েকদিন আগে খেয়াল করলাম, আজকাল বাবু ভাই প্রায়ই আমার বাসায় আসেন। একা আসেন না, সঙ্গে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে আসেন। তিনি যতক্ষণ ঘরে থাকেন, আমার জানালা থেকে ইটের ভাঁটার মত ধোঁয়া বের হয়।

উনার অবস্থা বুঝতে পেরে আমি বললাম, ‘আপনার বাসা কি নন স্মোকিং জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে?’

বাবু ভাই নির্বিকার হয়ে বললেন, ‘ফলফ্রুটের মধ্যে শুধু সিগারেটটাই খাই। এটা নিয়েও সমস্যা। কোনো মানে হয়? বাসায় না-কি সিগারেট ধরানো যাবে না। তার ওপর শরীর সুস্থ রাখার কলাকৌশল নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা! কথায় কথায় স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল।’

আমি বললাম, ‘পাঠ্যবইয়ের ভাবসম্প্রসারণ সিরিয়াসলি নেয়াতে এরকম হয়েছে।’

‘মানে?’

‘খেয়াল করলে দেখবেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেকবার ক্ষমতা বদল হয়েছে, কিন্তু ভাবসম্প্রসারণগুলো বদলানো হয়নি। একই থেকে গেছে। ভাবি মনে হয় ওগুলো ক্লাসে পড়ান।’

‘হতে পারে।’

‘তবে, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, স্ত্রীই সকল অসুখের মূল। ভাবসম্প্রসারণ হিসেবে এটাকে যুক্ত করতে পারলে বৈপ্লবিক ব্যাপার হবে।’

আমার কথায় তিনি মজা পেলেন না। চুপ করে রইলেন। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিবাহিত পুরুষগুলো অন্যরকম হয়। যতক্ষণ নিজ থেকে কথা না বলে, ততক্ষণ চুপ করে থাকাই মঙ্গল।

কিছুক্ষণ পার হবার পরবাবু ভাই নিজেই বললেন, ‘গতকাল এ নিয়ে প্রচুর ঝগড়া হল। আ-রে, যে জিনিস আমি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছি, তা কি বর্জন করা যায়? আমি কী চাইলে বিয়েটা বর্জন করতে পারব? পারব না।’

আমি বললাম, ‘দরকার কি? বিয়ে তো মাদক না, যে বর্জন করবেন।’

‘নিহিকে বলতেই সে বলল, আল্লাহ্‌ আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও। এই লোকের সঙ্গে সংসার করা অসম্ভব। নিজের ভালোটাও বোঝে না।’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কী! আমিও বললাম, হে আল্লাহ্‌ আমার প্রার্থনা কবুল করছো না, ঠিক আছে। আমার বউয়েরটা হলেও করো।’

‘দুজনের প্রার্থনার ফলাফল কি?’

‘এরপর থেকে কথা বলা বন্ধ।’

এ কথা সত্যি হলে বাবু ভাই আর নিহি ভাবির মধ্যে সামান্য মিল আছে। তাদের দুজনের কারও প্রার্থনাই কবুল হয় না।

 

আজ সোমবার সকালবেলা বাবু ভাইকে দেখলাম, ইস্ত্রি করা কাপড় পড়ে অফিসে যাচ্ছেন। যতোটুকু জানি, উনার অফিসের কোনো ড্রেসকোড নেই। মূলত এ কারণেই চাকুরীটা করেন। তাকে পরিপাটি অবস্থায় দেখে আমি বললাম, ‘ভাই, আপনার শার্ট তো প্যান্টের ভিতর ঢুকে গেছে। কারণ কি?’

উনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ওদের মধ্যে এফেয়ার চলছে।’

এই কথা শোনার পর আর কিছু বলা যায় না। তারপরেও আমি একটা ব্যাপার আবিস্কার করে চমকে উঠলাম।

বাবু ভাই এ পৃথিবীতে এসে—জেমসের গান গাওয়া, সিগারেট খাওয়া আর পরিপাটি না থাকার যে তিনটি অভ্যাস রপ্ত করেছিলেন, বিয়ের তৃতীয় সপ্তাহে এসে তার একটিও রইল না। এই তালিকা থেকে অলসতা বাদ যাওয়ার কারণ, এটি তাকে অর্জন করতে হয়নি। একেবারে জন্মগত প্রতিভা।

যা হোক, আমি চাইলে বাবু ভাইয়ের জন্যে একটি গাঢ় দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারতাম। কেনো জানি তাও করলাম না। কারণ, নাম মনে না থাকা এক মনীষী বলেছেন, নিয়তি আমাদের যা কিছু দেয় তার একটি হল স্ত্রী।

 

ডিসেম্বর, ২০১৬

e-mail: nazmussaqeeb1@gmail.com

 

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন