শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২ , ২০ শাওয়াল ১৪৪৬

সাহিত্য
  >
গল্প

গল্পটি শিরোনামহীন

ফারজানা মিতু আগস্ট ৯, ২০১৭, ১৭:৪৪:৩৭

6K
  • গল্পটি শিরোনামহীন

রইসুদ্দিন চোখ বড় বড় করে সবাইকে দেখছে। বুঝে উঠতে পারছে না আসলে কি হবে আজকে। ওরা সবাই মিলে অনেকক্ষণ ধরে গ্যারেজের কাঠের থাম্বার সাথে ওকে বেঁধে রেখেছে। প্রথমে কিছুক্ষণ অনেক চড় থাপ্পড় দিলেও, এখন সবাই দুই দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের ভেতর আলোচনা করছে।

আলোচনা করতে করতে কেউ সিগারেট ধরিয়েছে, কেউ প্লাস্টিকের বোতল থেকে পানি ঢক ঢক করে খাচ্ছে। ওদের পানি খাওয়া দেখে রইসুদ্দিনের আবারও গলা শুকিয়ে আসে। পানি চাইতে সাহস হয় না। বলা যায় না পানি চাইতে গেলে আবারও মাইর দেয় কি না। এমনিতেই সারা শরীর এখনও ব্যথা করতেছে। সেই কখন সকালে পানি ভাত খাইছে তারপর আরকিছু খায় নাই। এখন বেলা কম করে হলেও তিনটা। পেটে কিছু দেওন দরকার। এদের যে ভাব তাতে খাবার তো পরের কথা, কপালে যে কি আছে রইসুদ্দিন জানে না। উফ, পিছনে এতো শক্ত করে হাত বাঁধছে যে টন টন করতেছে। একটু আলগা করে দিলে ক্ষতি কি, ওর কি সাহস আছে যে পালায় যাইবো? পালায় যাইবো কই? ওরা মা আর ছেলে থাকে পাশের বস্তিতেই। এই গ্যারেজের যে মালিক সেই নুরু মিয়ার বাড়িতেই ওর মা কাম করে। রইসুদ্দিন জানে ওকে না পেয়ে ওর মা সব জায়গায় খুঁজবো। খুঁইজা না পাইয়া ভাববো, কোথাও গেছে রাত বাড়লেই ফিরে আইবো। গ্যারেজের দরজা নামানো, রইসুদ্দিন হাজার চিল্লা চিল্লি করলেও কেউ শুনবো না। ওর মা আর যাই করুক এই গ্যারেজে ছেলেরে খুজতেও আইবো না। পেটে আবারও ডাক দিয়া উঠে খিদায়।

ইমরান, কায়েস তোরা কই গেলি?

জি বস।

কি করস তোরা সব? বসের সামনে দাঁড়ায় সবাই ইতস্ত করতে থাকে। সবাই সবার সাথে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকে। বস একটু সমস্যা হইছে।

নুরু মিয়ার ছোট চোখ আরও ছোট করে জিজ্ঞেস করে, কি হইছে? কি ঝামেলা হইছে আবার? সারাদিন পর সন্ধ্যার আগে আগে নুরু মিয়া প্রতিদিন গ্যারেজ হয়ে তারপর বাড়িতে যায়। সারাদিনের টাকা-পয়সা কোমরের ঝুলানো ব্যাগে ঢোকায় নেয়। আজকেও সেটার কারনেই গ্যারেজে আসছে। কি কথা কস না কেন তোরা? মাল ডেলিভারি দিয়া যায় নাই?

ইমরান মাথা চুলকায়, দিছে বস।

তাইলে? আরে খানকীর পুত কইতে পারস না কি হইছে, মাথা চুলকাস কেন?

বস, একটা সমস্যা হইছে।

আরে বান্দির পোলা এইটা তো একবার কইলি, এইটা কি আবার শুনতে চাইছি? আরে কইতে পারস না সমস্যা কি?

বস, মাল ডেলিভারি দিছে আর টেকাও দিছে কিন্তু আমাগো সব কারবার রইসুদ্দিন দেইখা ফালাইছে। বেটা যে বান্দর, যদি মুখ ফুসলায় কিছু কইয়া ফালায় তাইলে বস আপনি শেষ। আপনি শেষ হইলে আমরাও শেষ। 

কি কইলি? রইসুদ্দিন দেইখা ফালাইছে? তগো বার বার কইছি গ্যারেজের ভিতরে সব আটকাইয়া কারবার করবি, কই নাই? বোতলগুলা কই রাখছস?

সবই আছে বস কিন্তু রইসুদ্দিনরে নিয়া কি করুম? গ্যারেজের ভেতর থেকে জামাল, বিচ্ছু আর খালেক বের হয়ে আসে। ওস্তাদ, সালাম। 

তোরা এতোগুলা মরদ থাকতে এই কাম হইলো কি কইরা বিচ্ছু? 

ওস্তাদ ভুল হইয়া গেছে। 

নুরু মিয়া চিন্তায় পরে যায়। লাখ লাখ টাকার কারবার ফেন্সিডিলের, এইটা কেউ যাইনা গেলে সর্বনাশ হইয়া যাইবো। রইসুদ্দিনের বয়স কম, মুখ ফোস্কায় কাউরে কইয়া দেওন কোনো ব্যাপার না। উপরের মহলে লোক আছে কিন্তু তারপরও সাবধানের মাইর নাই।

কি করবার চাস এখন তোরা?

ওস্তাদ বুঝবার পারতেছি না। বেটারে অনেক ডলা দিছি কিন্তু কাম হইবো কিনা বুঝবার পারতেছি না। শালা বান্দর একটা। এখন আবার কয় খিদা নাকি লাগছে।   

বাইরের কোন কথা শুনা না গেলেও রইসুদ্দিন নুরু মিয়ার গলা শুইনা বুইঝা যায় সবাই নুরু মিয়ার লগে কথা কইতেছে। কেন জানি বুকের ভেতরটা কাঁইপা ওঠে। নুরু মিয়ারে সবাই অনেক ডরায়। মাইনসে কয়, নুরু মিয়া পারে না এমন কোনো কাম নাই। রইসুদ্দিন ভাইবা পায় না, ওর দোষ কি আছিলো? রইসুদ্দিন একটা চাকা ঘুরাইতে ঘুরাইতে গ্যারেজের সামনে আইসা পরছিলো। আইসা দেখে কেউ নাই। ভাবছে কেউ যখন নাই তাইলে ভিতরে ঢুইকা দেখি কেমন। রইসুদ্দিনের অনেকদিনের ইচ্ছা ভিতরে একটু ঢুইকা দেখা। ভিতরে আইসা দেখে কতো যে শিশি আরঅনেকগুলা লোক মিলা টেকা হিসেব করতেছে। ওই তুই কি চাস? ওরে দেইখা একজন চিল্লায় উঠলো আর বেবাকে মিলা ওরে যাইতা ধরলো। খিদা, পিয়াস আর সাথে এখন ভয়। রইসুদ্দিনের কচি বুকটা ফাল পারতে থাকে। মারে তুই কই?  আমার না অনেক ডর লাগতেছে মা। আজকে না তোর ডিমের সালুন পাক করবার কথা? কতদিন ডিমের সালুন খাই না। রইসুদ্দিনের চোখ ফেটে জল আসে।

বুঝছস তোরা কি কইলাম?

বুঝছি ওস্তাদ।

বুঝস তো সবই কিন্তু কামের সময় কিছুই পারস না। গ্যারেজের দরজা ভালো কইরা আটকায় লইবি। আর মুখের মধ্যে কাপড় ঢুকায় লইবি। কোনো চিৎকার যেন বাইরে না যাইতে পারে। রাত থাকতেই কাজ খতম। কোন চিহ্ন যেন থাকবার না পারে। আমি যাই, বহুত খিদা লাগছে। আইজকা বাড়িতে খাসী জবাই দিছে, খাসীর শরীরে যে চর্বি আছিলো। যাই, তোরা কাম শেষ কইরা আমারে খবর দিস কইলাম।

চিন্তা কইরেন না ওস্তাদ। আর কোনো ভুল হইবো না।       

নুরু মিয়া পকেটে পাঁচটা এক হাজার টাকার বান্ডিল চালান কইরা বাইর হইয়া পরে। ইস কি যে গরম পরছে আইজকা, যাই। নুরু মিয়া যাইবার পর কায়েস, বিচ্ছু আর জামাল ভিতরে যায় আর ইমরান আর খালেক বাইরে গেটের সামনে নীচে চাদর বিছায়  তাস খেলবার ছলে পাহারায় বসে। 

বিচ্ছুকে আগায় আসতে দেইখা রইসুদ্দিন ভয়ে চোখ বুজে। বুঝবার পারে আবারও মাইর শুরু হইবো। পেটের খিদায় কি মাইর সহ্য হয়? রইসুদ্দিনের চোখে পানি চইলা আসে। ভাইজান আমারে একটু পানি দিবেন? অনেক পিয়াস লাগছে। একটু দিলেই হইবো, অনেক লাগতো না।

পানি খাইবি? পিয়াস লাগছে?

হও, ঢোক গিলবার পারতেছি না ভাইজান। একটু দেন না।

কায়েস এই বান্দর দেখি আবার পানি চায়। বেটারে পানি খাওয়া বেশী কইরা। জামাল আর বিচ্ছু একই সাথে হেসে ওঠে। ওদের হাসি দেখে দশ বছরের রইসুদ্দিন আবারও ভয়ে কুঁচকায় যায়। একসময় বুঝে যেখানে বইসা আছে, সে জায়গা ভিজে গেছে পেশাবে। ওই কায়েস দেখ হারামজাদা আবার প্যান্ট ভিজায় ফেলাইছে। ওই পানি আন, বেটারে পানি খাওয়াই আরও যাইতে মুতবার পারে। রইসুদ্দিন কাইন্দা ফেলে, আমারে আমার মায়ের কাছে যাইতে দেন, আমি পানি খামু না, আমার পিয়াস লাগে নাই।    

খালেকের হাতে পানির পাইপ।দুরন্ত বেগে ছুঁইটা আসে পানি। তুই না পানি খাবি, ল পানি খা। নাহ, না আমি পানি খামু না, রইসুদ্দিন ভয়ে চিৎকার করে। খালেক এসে পানির পাইপ রইসুদ্দিনের মুখে চেপে ধরে। কলের গড় গড় করে আসা পানি উপচায় পরতে থাকে। মুখের ভেতর জায়গা হয় না রইসুদ্দিনের, মুখ সরায় নিতে চেয়েও পারে না। কানে এসে বাজে বিচ্ছুর হাসি, খা প্রাণ ভইরা পানি খা। রইসুদ্দিনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে নেয়, এদিক ওদিক মাথা ঘোরায়। চোখ কোঠর থেইকা বাইর হইয়া আসতে চায়। ছোট দেহটা ছটফট করে ওঠে নিঃশ্বাস নিতে না পারায়। রইসুদ্দিন শেষ বারের মতো খালেকের দিকে তাকায় কি জানি বলতে চায় কিন্তু পারে না। মুখে না পারলেও মনে মনে রইসুদ্দিন বলে, আমারে তো মরা এতো কষ্ট দিয়া মারলা? আমি কি করছিলাম? আমি শুধু আমার মায়ের কাছে যাইবার চাইছিলাম। মা-রে, কই তুই? আমি তোর কাছে যামু।

 

নিউজজে/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন