শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১ , ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

বিনোদন

স্বর্ণালি যুগের মায়াবী অভিনেত্রী রোজী আফসারী

নিউজজি ডেস্ক  এপ্রিল ২৩, ২০২৪, ১১:৪৯:০৯

65
  • ছবি-ইন্টারনেট

ঢাকাই চলচ্চিত্রের একসময়কার অন্যতম দাপুটে অভিনেত্রী তিনি। কখনো নায়িকা, কখনো বড় ভাবী, মা কিংবা বিধবা চরিত্রে প্রাণবন্ত অভিনয়ে মুগ্ধ করেছেন এদেশের সিনেপ্রেমীদের। পাশাপাশি মহীয়সী নারী চরিত্র, বাদশাহ মহলের নির্বাসিত বেগম কিংবা পরম শ্রদ্ধেয় বড় বোনের চরিত্রেও দুর্দান্ত অভিনয়ের দেখা মিলেছে তার। এমনি নানা চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়-শৈলীতে সবার মন জয় করেছিলেন কিংবদন্তি অভিনেত্রী রোজী আফসারী।

বাংলা চলচ্চিত্র অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র তিনি। এদেশের সিনেমার ‘সুবর্ণ যুগ’ খ্যাত সময়ের দাপুটে ও প্রভাবশালী নায়িকা ছিলেন রোজী। বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালী দিনের কথা মনে করলেই যার প্রিয় মুখটি চোখের সামনে ভেসে উঠে তিনি রোজী আফসারী।

প্রকৃত নাম শামীমা আক্তার রোজী হলেও এক সময় রোজী সামাদ নামেই পরিচিত ছিলেন গুণী এই অভিনেত্রী। পরবর্তীতে নিজের নামের শেষে স্বামী মালেক আফসারীর নামের শেষাংশ ব্যবহার করেন। সেই থেকে তার নাম হয়ে উঠে রোজী আফসারী। তিনি ১৯৬২ সালে অভিনয় জীবন শুরু করেন এবং ২০০৫ সালে তার অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘পরম প্রিয়’ মুক্তি পায়।

শামীমা আক্তার রোজী ১৯৪৯ সালের ২৩ এপ্রিল লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের শমসেরাবাদ এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কবি ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন পেশায় একজন ঠিকাদার। মা হাসনাহেনা আকতারী বেগম ছিলেন একজন সঙ্গীতশিল্পী। একসময় মঞ্চের নামকরা শিল্পীও ছিলেন আকতারী বেগম। নবাব সিরাজ উদ-দৌলা নাটকে লুৎফার চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। নানা সৈয়দ ফজলুল করিম কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।

চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় রোজী। মেজ বোন শিরিন আখতার বেবী সংস্কৃতি অঙ্গনের সঙ্গে জড়িত ছিল। তৃতীয় বোন প্রয়াত পারভীন আকতার রুহি ছিলেন চিত্রনায়ক ওয়াসীমের স্ত্রী। ভাই হাসান শহীদ বাবুও এক সময় চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।

রোজী আফসারী কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে ভর্তি হন ভিকারুন্নেছা নূন স্কুলে। সে সময়ই চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে। দেশবরেণ্য চিত্রগ্রাহক ও চলচ্চিত্রকার এম এ সামাদ ছিলেন রোজী সামাদের স্বামী। কবিতা নামে তাদের একটি মেয়ে আছে।

বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণালি যুগের সোনালী অভিনেত্রী রোজী ১৯৬২ সালে আব্দুল জব্বার খান পরিচালিত ‘জোয়ার এলো’ সিনেমার মাধ্যমে অভিনয় জীবন শুরু করেন। তবে তিনি জনপ্রিয়তা পান নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘আলোর মিছিল’ সিনেমাতে অভিনয় করেন। তখনকার অন্তত ১০টি সুপারহিট লাভ মুভির নায়িকা ছিলেন তিনি।

এরপর প্রায় ৪ দশক ধরে রোজী প্রায় ৩৫০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এর মধ্যে পাকিস্তানের ‘জাগো হুয়া সাবেরা’, ‘পুনম কি রাত’সহ ২৫টি উর্দু সিনেমাতে অভিনয় করেছেন তিনি। তার অভিনীত সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সূর্য গ্রহণ’, ‘সূর্য সংগ্রাম’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। এছাড়া অন্যান্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘ওরা ১১ জন’, ‘লাঠিয়াল’, ‘এতটুকু আশা’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘অশিক্ষিত’, ‘প্রতিকার’ ইত্যাদি।

শুরুর দিকে জাদরেল ঘরণী চরিত্রে অভিনয় করে তাক লাগিয়েছিলেন রোজী। এরপর তার কোমল, মোহনীয় রূপে মাতাল করেছেন সববয়সী পুরুষকে। মোহিত করেছেন নারীদেরও। সংগ্রামী নারীর প্রতিভু চরিত্রে রোজী এক বিস্ময়। তার চোখ, মুখে যে আগুন দেখা যেত তার সার্থক প্রতিফলন হলো লাঠিয়াল, আমার সংসার, ওমর আকবর, তিতাস একটি নদীর নাম -চলচ্চিত্র সমূহে।

রোজী আফসারীকে বলা হয় ঢালিউডের সবচেয়ে মায়াবী চেহারার মা। আশির দশকে বহু সিনেমাতে রোজী আফসারী মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এর মধ্যে ‘জোয়ার ভাটা’, ‘দ্বীপ নেভে নাই’, ‘ছোট মা’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘অশিক্ষিত’, ‘মহেশখালীর বাকে’, ‘জুলি’ অন্যতম।

পরিচালকদের মধ্যে নারায়ণ ঘোষ মিতা ও এজে মিন্টুর পরিচালনায় সর্বাধিক সিনেমাতে অভিনয় করেন রোজী। পরবর্তীতে স্বামী মালেক আফসারী সাথে প্রচুর কাজ করেন। নায়ক তথা জুটি হিসাবে রোজী আফসারী সাথে অভিনেতা আনোয়ার হোসেন, খলিল ও শওকত আকবর এবং বুলবুল আহমেদকে বেশি দেখা গেছে।

১৯৮১ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক মালেক আফসারীকে বিয়ে করেন রোজী। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনি ‘এ’ লেভেল শেষ করে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেছিলেন। তার দুই সন্তান। ছেলে রবি আফসারী ও মেয়ে কবিতা সামাদ। চার দশকের বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্রে দাপটের সঙ্গে দ্যুতি ছড়ানো এ অভিনেত্রী ১৯৮৫ সালে বিয়ে করেন চলচ্চিত্র নির্মাতা মালেক আফসারীকে।

বয়সে মালেক আফসারী তার ২০ বছরের ছোট হলেও দীর্ঘ ২২ বছর সংসার করেন তারা। শেষ জীবনে মেয়ে কবিতা সামাদের সাথে আবাসিক প্রকল্পের এক বিজ্ঞাপন চিত্রে ও অভিনয় করেন গুণী এই অভিনেত্রী। দ্বিতীয়বার বিয়ের পর অভিনয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে রোজী আফসারী নিজের প্রতিষ্ঠান রোজী ফিল্মসের ব্যানারে অসংখ্য সিনেমা প্রযোজনা করেছেন।

ধনী-গরীব, ক্ষতিপূরণ, ক্ষমা, ঘৃণা, এই ঘর এই সংসার প্রভৃতি সিনেমা রোজী ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত হয়। অভিনয় আর প্রযোজনার পাশাপাশি রোজী আফসারী একটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন। ১৯৮৬ সালে প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন রোজী আফসারী। সে বছর রোজীর পরিচালনায় মুক্তি পায় চলচ্চিত্র ‘আশা নিরাশা’। চলচ্চিত্রটির কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচনা করেন মালেক আফসারী।

অভিনয় ক্যারিয়ারের পাশাপাশি বেশ কিছু সিনেমাতে তিনি নৃত্য পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। লন্ডন, সুইডেন, মিসর, সিরিয়া, কানাডা, পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন রোজী আফসারী। ‘লাঠিয়াল’ সিনেমাতে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে ১৯৭৫ সালে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন রোজী। তিনি ৭২,৭৩,৭৪,৭৫ সালের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।

শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জিয়া স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি পুরস্কার, বাচসাস, পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার, এফডিসির রজত জয়ন্তী পুরস্কার, কালচারাল রিপোর্টাস অ্যাওয়ার্ড, স্বদেশ সাংস্কৃতিক স্বর্ণপদক, অনির্বাণ সংসদ স্বাধীনতা পদক, মহিলা চিত্রপরিচালক হিসেবে সিডাব পুরস্কার,পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘নিগার’সহ দেশি-বিদেশি প্রায় ৫০টি পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।

রোজী আফসারী দীর্ঘদিন ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। তার দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে যায়। চার বছর ধরে নষ্ট হয়ে যাওয়া কিডনি নিয়ে তিনি বেঁচে থাকার জন্য লড়ছিলেন। ২০০৭ সালের ৯ মার্চ মাত্র ৫৭ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে অসংখ্য ভক্ত-দর্শককে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান সকলের প্রিয় অভিনেত্রী রোজী আফসারী। সশরীরে তিনি না থাকলেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাকাশে এক অনন্য উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়েই অগণিত মানুষের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবেন রোজী আফসারী।

নিউজজি/এস দত্ত

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন