বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ৩২ বৈশাখ ১৪৩১ , ৭ জিলকদ ১৪৪৫

শিল্প-সংস্কৃতি

মেলোডির শেষ প্রতিনিধি আলী হোসেনের বিদায়

আহসান রফিক ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১৪:৩৭:৪৩

3K
  • ছবি: ইন্টারনেট

ষাটের দশকের প্রারম্ভে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে রোম্যান্টিক, সেমি ক্ল্যাসিক্যাল, সফট ও ফাস্ট রোম্যান্টিক সংগীতের যে যাত্রা শুরু হয় তাতে সক্রিয়ভাবে সামিল ছিলেন সদ্যপ্রয়াত আলী হোসেন। আধুনিক গীতি কবিতাকে নিজস্ব সুর শৈলী দিয়ে আবেদনময় করে তোলাতে যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তিনি।

নিজস্ব উদ্ভাবনী দক্ষতায় তৈরি অজস্র সুরেলা গান, বর্ণাঢ্য অতীত, হাজার হাজার অনুরাগীকে পেছনে ফেলে অবশেষে  গত ১৭ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার বোস্টনের একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন বাংলা গানের সোনালী যুগের অন্যতম কারিগর আলী হোসেন( ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।

১৯৪০ সালে পশ্চিমবঙ্গের খিদিরপুরে জন্মগ্রহণ করেন আলী হোসেন। তার বাবা ছিলেন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা যিনি ক্ল্যাসিক্যাল চর্চা করতেন। স্বাভাবিকভাবে আলী হোসেনের সংগীতের হাতেখড়ি হয়েছিল বাবার কাছে। দেশভাগের সময় পরিবারের সাথে করাচিতে পাড়ি জমান তিনি। করাচি রেডিওতে এনলিস্টেড হয়েছিলেন ১৯৫৭ সালে।

রেডিও প্রোগ্রামের পাশাপাশি নজরুল একাডেমিতে চাকুরি করতেন। তার সুরারোপিত প্রথম ছবিটি ছিল কামাল আহমেদ পরিচালিত উর্দু ছবি পারওয়ানা। তিনি কুলি, দাগ, ছোটসাহেব, আনাড়ি, পায়েলসহ বেশ কিছু ঢাকা মেইড উর্দু ছবির সংগীত পরিচালনা করেন। ১৯৬৮ সালে মুস্তাফিজ পরিচালিত পায়েল ছবিতে মাহমুদুন্নবীর গাওয়া, হাওয়া ধীরে বেহেনা ঘাটা ধীরে চাল না গানটি আলী হোসেনের এক অসাধারণ সৃষ্টি।

দাগ ছবিতে আহমেদ রুশদীর গাওয়া, ল্যাব পার তেরা নাম, ছোট সাহেব ছবিতে একই শিল্পীর গাওয়া, ঝুটে ইয়ে সারা নাগারে ঝুটে ইয়ে সাংসারসহ অনেক গান শ্রোতা/ দর্শকদের হৃদয়কে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল। তার সুরে গান গেয়েছেন পাকিস্তানের প্রধান প্রধান শিল্পী মেহেদী হাসান, আহমেদ রুশদী, মালা, আইরিন পারভীন, মাসুদ রানা ও নাহিদ নিয়াজি।

আলী হোসেনের বাংলা ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসেবে অভিষেক হয় ১৯৬৬ সালে মুস্তাফিজ পরিচালিত ডাকবাবু ছবিতে। এ ছবিতে শাহনাজ রহমতুল্লাহর লিড ভয়েসে কোরাস, হলুদ বাটো মেন্দি বাটো বাটো ফুলের মৌ অদ্যাবধি বাঙালি কনেদের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের একটি ট্রেড মার্ক গান হিসেবে সমাদৃত। এ ছবিতে কিংবদন্তী শিল্পী সৈয়দ আ. হাদীর গাওয়া চাতুরী জানে না মোর বধূয়া গানটি ছিল শিল্পীর প্রথম একক কণ্ঠের প্লেব্যাক। একই ছবিতে আলী হোসেন ফেরদৌসী রহমানের সাথে একটি ডুয়েট পরিবেশনা করেন।

১৯৬৯ সালে মমতাজ আলী পরিচালিত নতুন নামে ডাকো ছবিতে তিনি খ্যাতিমান পাকিস্তানি গায়ক আহমেদ রুশদীকে দিয়ে একটি মিষ্টি রোম্যান্টিক গান কে তুমি এলে গো আমার এই জীবনে, নতুনও নামে ডাকবো তোমায় শুধু যে আমি এই জানি রেকর্ড করান। গানটি আজো শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে যায়। একই ছবিতে আরেক নামী পাকিস্তানি গায়িকা নাহিদ নিয়াজি একই সুরে গেয়েছিলেন, নতুনও নামে ডাকো আমায় এইতো ছিল কামনা এ গানটিও প্রেমিক হৃদয়কে দোলা দিয়ে গিয়েছিল। নতুন নামে ডাকো ছবিতে এম এ হামিদের কণ্ঠের একটি ফাস্ট কমেডি, মান মান মানিক মান্না কমেডি গানের এক চিরায়ত উদাহরণ হয়ে আছে।

আলী হোসেন মুস্তাফিজ, কামাল আহমেদ, মমতাজ আলী, সাইফুল আজম কাশেম প্রমুখের ছবিতে বেশির ভাগ কাজ করেছেন। ডাকবাবু ও নতুন নামে ডাকো ছাড়াও তিনি  অধিকার, অবাঞ্চিত, রুপকুমারী, একই অংগে এত রুপ, অশ্রু দিয়ে লেখা, সোহাগ, ঘর সংসার, দাতা হাতেম তাই, অংগার, বৌরানী, কালো গোলাপ, আপন জন, বাদশা, রাজা সাহেব, বিজয়িনী সোনাভান,  ঈমান, কুদরত, ধন দৌলতসহ শতাধিক ছবির সংগীত পরিচালনা করেন।

আলী হোসেনর সুরারোপিত অজস্র গানের মধ্যে আছে- অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান, ও দুটি নয়নে স্বপনে চয়নে, না সরে যেও না, জানি না সে হৃদয়ে কখন এসেছে, ওগো রুপসী তোমারে ভালবেসেছি আমি, জীবনে রঙ চিরদিন রবে না, কোন লজ্জায় ফুল সুন্দর হল, কে যেন আমায় ডাকে প্রিয় নাম ধরে, ভীন দেশি এক রাজার কুমার, হায় রে জীবনের একি পরাজয়, আরে ও প্রাণের রাজা, চলার নাম গাড়ি রে, শিল্পী আমি তো নই, স্লামালেকুম কেন এতো দেরি হল, এ আকাশকে স্বাক্ষী রেখে ( ২টি ভার্সানে), হায় রে কী সৃষ্টি দেখে এ দৃষ্টি, অমন করে যেও না গো তুমি, আজ গায়ে হলুদ পায়ে আলতা হাতে মেন্দি, আমি সাজবো ও সাজবো নতুন সাজে, কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, কে গো তুমি দূরে থেকে আমারে যে যাও ডেকে, আমি ভালবাসি যারে সে যে কেন বোঝে না, চোখ ফেরানো যায় গো তবু মন ফেরানো যায় না, ওরে মন পাপিয়া, বল না একবার এ রাত তোমার আমার।

কণ্ঠশিল্পী উমা খানের জীবনের সেরা দশটি গানের অন্তত ৪টি গান আলী হোসেন সুরারোপিত। গানগুলো  হলো:

১। আজ মানুষেরও দ্বারে মানবতা কেঁদে মরে

২। আমি পথ চেয়ে বসেছিনু একা

৩। ও দুটি হাত চিরদিন থাক হয়ে মোর গয়না

৪। ভালবাসা বিনা বাঁচা যায় না (এ গানটির ফিনিশিং লাইন খালিদ হাসান মিলুর গাওয়া যা ছিল গায়কের প্রথম প্লেব্যাক)

১৯৮২ সালে রাজা সাহেব ছবির জন্য মেহেদী হাসানের কণ্ঠে যে গান তিনি তুলে দিয়েছিলেন তা ছিল বাংলাদেশি প্লেব্যাকের সেরা ক্ল্যাসিকো- ঢাকো যত না নয়ন দুহাতে বাদল মেঘ ঘুমাতে দেবে না।

অর্কেস্ট্রেশন, ভ্যারাইটি, রিদম, ফ্লাকচুয়েশন সব কিছু মিলে আলী হোসেনের সুর ছিল উঁচু মানের ইনোভেশন। বিশেষতই মো. খুরশীদ আলমকে দিয়ে তিনি কিছু হাই পিচের গান করিয়েছেন যা ছিল তার সফল এক্সপেরিমেন্ট। গীতিকবি ড. মো. মনিরুজ্জামানের সাথে ছিল তার এক সফল জুটি। ডাকবাবু, অশ্র দিয়ে লেখা, বাদশা, সোহাগ, দাতা হাতেম তাই, ঘর সংসার, রাজা সাহেবসহ প্রায় বিশটি ছবিতে স্মরণীয় কাজ করেন এই জুটি। এ জুটির একটি স্মরণীয় রেডিওর বেসিক গান, শওকত হায়াত খানের গাওয়া, জীবন বেলায় মিছে যত সঞ্চয়।

আলী হোসেন সুরারোপিত আরো কিছু রেডিওর বেসিক গান:

"আঁকা বাঁকা নদীর ধারে" (মো. খুরশীদ আলম)

"ভুল করে পথ চলেছি" (মো. আলী সিদ্দিকী)

"ওই সূর্য টা যদি আর না দেয় আলো" (মো. রফিকুল আলম)

"এই রাত বয়ে চলে আজ যাক না (খন্দকার ফারুক আহমেদ)

আলী হোসেনের মৃত্যুতে সুরের আকাশের শেষ নক্ষত্রটির পতন হল। একজন আলী হোসেনের শূন্যতা পূরণ করা প্রায় অকল্পনীয়।

নিউজজি/আইএইচ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন