রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১ , ৪ জিলকদ ১৪৪৫

সাহিত্য
  >
প্রবন্ধ

শামসুর রাহমানের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ ও বিপ্লবগাথা

ফারুক হোসেন শিহাব অক্টোবর ২৩, ২০১৯, ১৬:৪৪:১৬

9K
  • শামসুর রাহমানের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ ও বিপ্লবগাথা

পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।  নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ত্রিশ লক্ষ শহিদ আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ড বিশ্ব মানচিত্রে এক নতুন রাষ্ট্র হিসেবে উদিত হয়। শুধু সশরীরে যুদ্ধই নয়, মরণপণ এই যুদ্ধে অবতির্ণ হওয়ার জন্য নানাভাবে এতে শামিল হয়েছিলেন ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এদেশের সর্বস্তরের মানুষ। 

কবিতা, গান কিংবা নাটকের মধ্য দিয়ে মুক্তিকামীদের প্রাণিত করেছিলেন আমাদের সাহিত্য ও শিল্পীসমাজ। তাদের অনেকেই মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে সম্মুখ যুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন। শিল্পী সমাজের শানিত উচ্চারণ সেদিন বাংলার আকাশ-বাতাশ প্রকম্পিত করে সাহস আর প্রেরণার মন্ত্র বুনেছিল স্বাধীনতাকামী প্রতিটি বাঙালির চেতনে-মননে।

মুক্তিযুদ্ধ তখন এদেশের কবি মানসে প্রচণ্ড উদ্বেগ-উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিলো। তার খানিকটা ধরা পড়ে প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমানের ‘টেলেমেকাস’ নামক কবিতায়। হোমারের মহাকাব্য ওডিসির কাহিনি কবিতাটির প্রেরণা। অডিসিউস যখন দেবতার অভিশাপে সমুদ্রে দিকভ্রষ্ট তখন বিভিন্ন দেশের রাজা অডিসিউজের পত্নী পেনোলোপকে বিবাহ করে ইথাকা দখল করতে চেয়েছিল। তাদের থামাবার জন্য পেনোলোপ একটি কৌশল অবলম্বন করেন।

তিনি একটি কাপড় বুনছিলেন, বলেন এটি বুনা শেষ হলে স্বয়ংবরা হবেন। কিন্তু দিনের বেলায় তিনে যা বুনতেন রাতের বেলায় তা খুলে দিতেন। সুতরাং বুনা আর শেষ হয় না। অন্যদিকে তার পুত্র টেলেমেকাস পিতার প্রত্যাবর্তনের জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকেন।

এই কাহিনিটি শামসুর রাহমান অসাধারণ কাব্য মহিমায় তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন। তিনি ঢাকাকে ইথাকা আর নিজেকে টেলেমেকাস রূপে দেখেছেন। আর পশ্চিম পাকিস্থানি যেনো আগ্রাসী বিদেশী রাজন্য। তিনি চাইছেন পিতা অডিউসকে, অর্থাৎ ঢাকার পরিত্রাকে- ইথাকায় রাখলে পা দেখতে পাবে রয়েছি দাঁড়িয়ে/দরোজা আগলে,পিতা,অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়।/ এখনো  কি ঝঞ্জাহত জাহাজের মাস্তুল তোমার/বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ুধ/আবার অভিজ্ঞ হাতে? তুলবে না ধনুকে এ টঙ্কার? (‘টেলেমেকাস’, নিরালোকে দিব্যরথ)।

শামসুর রাহমান একজন সমকাল ও সমাজ সচেতন কবি।

সমকালীন বাঙালির জাতীয় জীবনের প্রতিটি সংকটময় মূহুর্ত মূর্ত হয়েছে তাঁর কবিতায়। শামসুর রাহমানের কবিতায় বারবার উঠে এসেছে ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীর জীবন, একটি বিশেষ জনপথ, শহর, মানুষ ও স্বদেশসহ নানা ইত্যাদি প্রসঙ্গ। তিনি সম্মুখ যুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তাঁর হাতে ছিলো না রাইফেল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কবিতা লিখে বাঙালি জাতিকে সাহসী হওয়ার মন্ত্র দিয়েছিলেন তিনি। দেখিয়েছেন বিজয়ের স্বপ্ন, দিয়েছিলেন শক্তি, সাহস আর প্রেরণা। 

তার ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা একজন সস্ত্রস্ত, ব্যথিত কবির অভিজ্ঞতা ও ভাবনা বেদনার অভিজ্ঞান। শামসুর রাহমান এই কাব্যে যুদ্ধকে ছেঁকে তুলেছেন তাঁর অনবদ্য কব্য পঙক্তিতে। তিনি  নিজেকে একজন যোদ্ধা বা  বন্দী হিসেবে দেখেননি; দেখেছেন কবি হিসেবে। এ কাব্যের শরীরে-মাংসে-রক্তে ধরা পড়েছে একাত্তরের বুলেটবিদ্ধ হৃদপিণ্ডের ওঠানামা। 

‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতায় ‘স্বাধীনতা’ নামক  শব্দটিকে তিনি দেখেছেন বিভিন্নভাবে। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিকে তিনি ভরাট গলায় উচ্চারণ করে তৃপ্তি পেতে চেয়েছেন। শহরের অলি, গলিতে, আনাচে, কানাচে, প্রতিটি রাস্তায়, বাড়ীতে, সাইনবোর্ডে, পাখিতে, নারীতে ঝলকিত হতে দেখেছেন প্রিয় শব্দটিকে। স্বাধীন দেশের কবিদের সম্বোধন করে জানালেন যে তিনি আজ  ক্ষুব্ধ। কেননা স্বাধীনতা নামক শব্দটি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে বাঙলায়- অথচ জানে না ওরা কেউ/গাছের পাতায়, ফুটপাতে/পাখির পালকে, কিংবা নদীর দু’চোখে/পথের ধুলায়, বস্তির দুরন্ত ছেলেটার/হাতের মুঠোয়/সর্বদাই দেখে জ্বলে  স্বাধীনতা নামক শব্দটা।

বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ্য করে লেখেন অসাধারণ কবিতা ‘টেলেমেকাস’ (১৯৬৬ বা ১৯৬৭ সালে)। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান-এ কর্মরত থাকা অবস্থায় পেশাগত অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্র সঙ্গীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন যাতে আরো স্বাক্ষর করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, আহমেদ হুমায়ুন, ফজল শাহাবুদ্দীন।

১৯৬৮ সালের দিকে পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেন আইয়ুব খান যার প্রতিবাদে আগস্টে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন যাদের একজন ছিলেন শামসুর রাহমানও। কবি ক্ষুব্ধ হয়ে লেখেন মর্মস্পর্শী কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’।

১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি শহিদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান এবং তিনি লিখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। ১৯৭০ সালের ২৮ নভেম্বর ঘূর্ণিদুর্গত দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় ও মৃত্যুতে কাতর কবি লেখেন ‘আসুন আমরা আজও একজন জেলে’ নামক কবিতা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে। এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি লেখেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত ও বেদনামথিত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। 

শামসুর রাহমান ১৯৮৭ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী চার বছরের তিনি প্রথম বছরে ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’, দ্বিতীয় বছরে ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’, তৃতীয় বছরে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’ এবং চতুর্থ বছরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’ লেখেন। 

১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর লেখেন ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা’। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁর চেতনায় প্রবাহিত ছিল। শামসুর রাহমানের বিরুদ্ধে বারবার বিতর্ক তুলেছে কূপমণ্ডুক মৌলবাদীরা। তাঁকে হত্যার জন্য বাসায় হামলা করেছে। এতকিছুর পরও কবি তাঁর বিশ্বাসের জায়াগায় ছিলেন অনড়।

শামসুর রাহমানের মুক্তিযুদ্ধের কবিতার মধ্যে বহুল প্রচারিত দু’টো কবিতা হচ্ছে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ এবং ‘স্বাধীনতা তুমি’। কবিতাদ্বয় যুগল কবিতা নামে পরিচিত। কবিতা দুটোর অভ্যন্তরে শ্লোগানের প্রাবল্য লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য সে প্রাবল্যতাকে কবি শাসন করেছেন কবিতায় নরম আবেদনের মাধ্যমে। তাই যা হতে পারতো  নিছক শ্লোগান,তা হয়ে উঠেছে বিষাদের গাঁথা। যেমন- তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা/তোমাকে পাওয়ার জন্যে/আর কতোকাল ভাসতে হবে রক্ত গঙ্গায়/আর কতোবার দেখতে হবে খান্ডব দাহন?/ তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা/সখিনা বিবির কপাল ভাঙলো/সিথির সিঁদুর মুছে গেলো হরিদাসীর। 

এই কবিতায় শামসুর রাহমান স্বাধীনতাকামী এমন কিছু মানুষের কথা বলেছেন যারা একেবারে খেটে-খাওয়া মানুষ, দরিদ্র সাধারণ মানুষ। যেমন- উদাস হাওয়ায় বসে থাকা এক থুত্থুরে বুড়ো-যার চোখের নীচে অপরাহ্নের দুর্বল আলোর ঝিলিক। দগ্ধ ঘরের নড়বড়ে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মোল্লা বাড়ির এক বিধবা মহিলা। পথের ধারে শূন্য থালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক অনাথ কিশোরী। 

ঢাকার রিকসাওয়ালা রুস্তম শেখ, শাহবাজপুরের জোয়ান কৃষক সগির আলী, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি মতলব মিঞা এবং অন্য সবাই প্রতীক্ষা করছে স্বাধীনতা লাভের আশায়। কবিতাটির উপান্তে কবি আমাদের  নিশ্চিত আশার বাণী শুনিয়েছেন- পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত/ঘোষনার ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে/নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিকবিদিক/এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে/হে স্বাধীনতা। 

‘স্বাধীনতা’ সম্বোধন ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় প্রায় গানে পরিণত হয়েছে। যদিও সম্ভাবনা ছিলো শ্লোগানে পরিণত হওয়ার। কবিতাটি যে শ্লোগানে শিহরিত না হয়ে সুর মুখরিত হয়েছে এর মূলে রয়েছে শামসুর রাহমানের নিসঙ্গ পাশে কেউ নেই, তাই সম্ভব শুধু একান্ত, আন্তরিক, রুপময়, অতিশয়োক্তি-উজ্জ্বল প্রিয় সম্বোধন।

‘স্বাধীনতা’ নামক শব্দটিকে তিনি সাজিয়েছেন নানা বর্ণে-রুপে-সুরে  এবং তিনি তা সংগ্রহ করেছেন বাংলার নৈসর্গিক জীবনাচার থেকে। স্বাধীনতাকে নজরুলের বাবরি চুল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, শহীদ মিনার, পতাকা মিছিল, ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি, গ্রাম্য মেয়ের অবাদ সাঁতার ইত্যাদির সংগে তুলনা করেছেন। যেমন- ‘স্বাধীনতা তুমি/রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান/স্বাধীনতা তুমি/কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো/মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা।’

যুদ্ধকালীন প্রতিদিনের বাস্তবচিত্র ধরা পড়েছে ‘প্রাত্যহিক’ কবিতায়। পুলিশ এবং রাজাকারের দৌরাত্ম, নারীর চিৎকার, হাত বাঁধা আচ্ছা মানুষ, রাইফেলধারী পাঞ্জাবী  সৈনিক ইত্যাদির বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে এই কবিতায়। চারিদিক পালাবার সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়েছে হানাদার বাহিনীরা। যেমন- ‘পশ্চিমা জোয়ান আসে তেড়ে/স্টেনগান হাতে আর প্রশ্ন দেয় ছুঁড়ে  ঘাড় ধরে/ ‘বাঙালী হো তুম?’ আমি রুদ্ধবাক, কি দেব জবাব?/ জ্যোর্তিময় রৌদ্রালোকে বীরদর্পী সেনা/ নিমেষেই হয়ে যায় লুটেরা, তস্কর।’

কবিতাটির শেষের দিকে একাত্তরের পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি অর্থাৎ মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামাতে ইসলাম প্রভৃতির সমন্বয়ে গঠিত রাজাকার, আলবদর, শান্তিকমিটি, আলশামস ফ্যাসীবাদীদের কর্মতৎপরতার বর্ণনা এসেছে এভাবে- ‘তুমুল গাইছে গুণ কেউ কেউ কুণ্ঠাহীন খুনী/সরকারের। কেউ কেউ ইসলামী বুলি ঝেড়ে তোফা/বুলবুল হতে চায় মৃতের বাগানে।/অলিতে গলিতে দলে/মোহাম্মদী বেগ ঘোরে, ঝলসিত নাঙ্গা তলোয়ার/নেপথ্যে মীরজাফর বঙ্কিম গোঁফের নীচে মুচকি হাসেন।’

যুুদ্ধকালীন সময়ে এ দেশীয় দালাল এজেন্টদের সাহায্য সহযোগিতায় পাকিস্থান বাহিনীর  অত্যাচার ও নিপিড়ন ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো।  প্রথম দিকে পাকিস্থান বাহিনীরা এদেশের পথ-ঘাট কিছুই জানতো না। কিন্তু পরবর্তীকালে আমাদের দেশীয় স্বার্থপর ও লোভী দালালদের সংগে হাত করে  গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর এরা ধ্বংস ও লুটপাট করতে লাগলো।

একদিকে পাকিস্থানের বর্বর সেনাবাহিনী অন্যদিকে এদেশীয় আলবদর-রাজাকার বাহিনীর হত্যা,লুন্ঠন আর ধর্ষণের ফলে নির্বোধ ও নিরীহ বাঙালীর জাতীয় জীবন হয়ে উঠলো অতিষ্ঠ। তাই এই দুর্যোগময় পরিস্থিতি থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে  লাগলো বাঙালি। বাঙালি বুঝতে পারলো যুদ্ধ ছাড়া উদ্ধার সম্ভব নয়।

‘উদ্ধার’ কবিতায় সেই কথাই বিধৃত হয়েছে- ‘বিষম দখলীকৃত এ শহর/ পুত্রহীন বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করুন/যন্ত্রণা জর্জর ঐ বাণীহীন বিমর্ষ কবিকে/ .....জননীকে হারিয়ে সমপ্রতি খাপছাড়া/ঘোরে ইতস্তত তাকে জিজ্ঞেস করুন/হায় শান্তিপ্রিয় ভদ্রজন,/এখন বলবে তারা সমস্বরে। যুদ্ধই উদ্ধার।’

‘উদ্ধার’ ও ‘কাক’ কবিতাদ্বয় শামসুর রাহমানকে উদ্ধার করেছে আটকে পড়া বৃত্তাবদ্ধ জীবন থেকে। ‘উদ্ধার’ কবিতাটির কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। ‘কাক’ কবিতাটি আকারে কাকের মতো ছোট হলেও এর মধ্যে বিধৃত হয়েছে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের বাস্তব সমাজ আলেখ্য। 

মাঠে কোন গরু নেই, রাখাল ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। শূন্য মাঠ, নির্বাক বৃক্ষ, নগ্নরৌদ্র, স্পন্দমান কাক-এগুলো হাহাকার ও শূন্যতার প্রতীক। নিম্নে কবিতাটি তুলে ধরা হলো- ‘গ্রাম্য পথে পদচিহ্ন নেই। গোঠে গরু/নেই কোনো, রাখাল উধাও, রুক্ষ সরু/আল খাঁ খাঁ, পথ পাশ্বে বৃক্ষেরা নির্বাক/নগ্ন রৌদ্র চতুর্দিকে, স্পন্দমান কাক, শুধু কাক।’

বাংলা কবিতার অন্যতম এ প্রাণপুরুষের কবিতায় শুধু স্বাধীনতাই নয়, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা, প্রেম, দ্রোহ, বিশ্বজনীনতাও উঠে এসেছে এক সুনির্মল শিল্পবয়ানে। তিনি বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকের বিরলপ্রজ পঞ্চকবির পর তিনিই আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রসিদ্ধ। পঞ্চাশ দশক থেকে বাঙালি জাতির নানা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, সামাজিক জীবনের অসঙ্গতি, ব্রিটিশ ও পশ্চিমাদের শোষণের বিরুদ্ধে তার সোচ্চার কণ্ঠ কবিতায় নির্মিত হয় এক অনন্য বাক-প্রতিমা। 

এ জন্য তাকে স্বাধীনতার কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

আজ ২৩ অক্টোবর আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের ৯১তম জন্মদিন। কবি শামসুর রাহমানের পিতার বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরায় পাড়াতলী গ্রামে। ১৯২৯ সালের আজকের দিনে ঢাকার মাহুতটুলি নানার বাড়িতে তাঁর জন্ম। পরবর্তীতে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি।

তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতা সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায় ১৯৪৯ সালে মুদ্রিত হয়। শামসুর রাহমানের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ (১৯৬০),’ রৌদ্রকরোটিতে’ (১৯৬৩), ‘বিধ্বস্তনীলিমা’ (১৯৬৭), ‘নিরালোকে দিব্যরথ’ (১৯৬৮), ‘নিজবাসভূমে’ (১৯৭০), ‘বন্দী শিবির থেকে’(১৯৭২), ‘দু:সময়ের মুখোমুখি’(১৯৭৩), ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’ (১৯৭৪), ‘আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি (১৯৭৪), ‘এক ধরনের অহংকার’ (১৯৭৫), ‘আমি অনাহারী’ (১৯৭৬), শূন্যতায় তুমি শোকসভা’ (১৯৭৭), ‘প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে’ (১৯৭৮), ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’ (১৯৭৭), ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ (১৯৮২) ইত্যাদি।

কবি শামসুর রাহমান ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট সন্ধ্যায় ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ঢাকাস্থ বনানী কবরস্থানে, মায়ের কবরে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিসরূপ কবি শামসুর রাহমান পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, স্বাধীনতা পদকসহ দেশি-বিদেশি অনেক পুরস্কার সম্মাননা।

নিউজজি/এসএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন