রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১ , ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

বিনোদন

ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ: যার কাছে ঋণী দেশের উচ্চাঙ্গসঙ্গীত

নিউজজি প্রতিবেদক  এপ্রিল ২৬, ২০২৪, ০০:৪৭:০০

39
  • ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ: যার কাছে ঋণী দেশের উচ্চাঙ্গসঙ্গীত

তার নামটি উচ্চারণের আগে বলতে হয় ওস্তাদ। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, তিনি কোন মাপের সঙ্গীতজ্ঞ। উপমহাদেশের উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের একটা বড় অংশ দখল করে আছেন তিনি। আর বাংলাদেশে এই সঙ্গীতের প্রসারে তার ভূমিকা তো অসামান্য। সোনার বাংলার উচ্চাঙ্গসঙ্গীত যার কাছে দারুণভাবে ঋণী, তিনি ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ।

আজ ২৬ এপ্রিল বিখ্যাত এই সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের জন্মদিন। ১৮৮৪ সালের এই দিনে তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে জন্মগ্রহণ করেন ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ। বর্তমানে তা পড়ছে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নবীনগরে। তার বাবা প্রখ্যাত সেতার বাদক সবদর হোসেন খাঁ। যিনি সদু খাঁ নামেও পরিচিত ছিলেন। তার বড় ভাইয়ের নাম ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। যিনি উপমহাদেশের রাগ সঙ্গীতের প্রাণপুরুষ। তার আরেকজন ভাইয়ের নাম ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁ। তিনিও ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ।

সঙ্গীত পরিবারে জন্ম। তাই আয়েত আলী খাঁ’র সঙ্গীতে আসাটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। তবে দীর্ঘ পথচলায় তিনি নিজের দক্ষতার সুবাদেই সাফল্যের আকাশটা ছুঁয়েছেন। আয়েত আলী খাঁ’র সঙ্গীতে হাতেখড়ি ভাই আফতাবউদ্দিনের কাছ থেকে। ১০ বছর বয়স থেকে সঙ্গীতের তালিম নেওয়া শুরু করেন তিনি। সাত বছর তিনি সারগাম ও রাগের ওপর তালিম নেন। এরপর আয়েত চলে যান তার ভাই আলাউদ্দিন খাঁ’র কাছে। সেখানে গিয়ে তিনি সেতার ও সুরবাহার বাদ্যযন্ত্রের ওপর দীক্ষা লাভ করেন। এরপর ওয়াজির খা’র কাছ থেকে দীর্ঘ ১৩ বছরের তালিম নিয়েছেন আয়েত আলী খাঁ।

জীবনের বড় একটা সময় ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সঙ্গীতের ওপর দীক্ষা নিয়েছেন। যার ফলে তার সঙ্গীতে এসেছে বিশেষত্ব ও নতুনত্ব। কেবল সঙ্গীত পরিবেশনাই নয়, বাদ্যযন্ত্রের ওপর অসাধারণ দখল ছিল আয়েত আলী খাঁ’র। তিনি নিজেও তিনটি বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। এগুলো হচ্ছে চন্দ্র সারঙ্গ, মনোহরা ও মন্দ্রনাদ। এছাড়া সরোদ ও সুরবাহার বাদ্যযন্ত্রের আধুনিক রূপদানের কারিগরও তিনিই।

সঙ্গীত শিক্ষা লাভের পর ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ তৎকালীন মাইহার রাজ্যের সভাবাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ভাই আলাউদ্দিন খাঁ’র সঙ্গে পাশাপাশি বসে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন তিনি। তখন তাদের একটি গানের দলও ছিল। এরপর রামপুরের রাজদরবারেও সভাবাদক হিসেবে নিয়োগ পান আয়েত আলী খাঁ।

শিক্ষকতার কাজও করেছেন আয়েত আলী খাঁ। হ্যাঁ, সেটা অবশ্যই সঙ্গীত শিক্ষা। ১৯৩৫ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকে তিনি শান্তিনিকেতনে যান। সেখানে বিশ্বভারতীতে যন্ত্রসঙ্গীত বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিছু দিন পর শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন আয়েত আলী খাঁ। এজন্য পুনরায় দেশে ফিরে আসেন এবং ব্যক্তিগতভাবে সঙ্গীত চর্চা চালিয়ে যান।

দেশে ফেরার পর কেবল নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেননি আয়েত আলী খাঁ। তিনি সঙ্গীত প্রসারে জোরালো ভূমিকা রাখেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লায় তিনি দুটি সঙ্গীত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ বহু সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে তিনি ‘গভর্নর পদক’ লাভ করেন। তার পরের বছর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাকে ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মৃত্যুর এক বছর আগে ১৯৬৬ সালে তিনি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘প্রাইড অব পারফর্মেন্স’ অর্জন করেন। 

মৃত্যুর পরও আয়েত আলী খাঁ’র অর্জনের খাতায় যোগ হয় সম্মাননা। ১৯৭৮ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন তিনি। এছাড়া ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করে।

ব্যক্তিগত জীবনে ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ বিয়ে করেছিলেন উমর-উন-নেসা খানমকে। স্ত্রীর নামেই কুমিল্লায় বাড়ি তৈরি করেছিলেন তিনি। সে বাড়ির নাম ‘উমর কুটির’। আয়েত-উমর দম্পতির তিন পুত্র ও তিন কন্যা রয়েছে। এর মধ্যে তিন পুত্র হচ্ছেন প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ আবেদ হোসেন খান, বাহাদুর হোসেন খান ও মোবারক হোসেন খান। কন্যা ত্রয়ের নাম আম্বিয়া, কোহিনূর ও রাজিয়া।

১৯৬৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ। তিনি চলে গেছেন কিন্তু তার বর্ণাঢ্য সঙ্গীত জীবনের রেশ রয়ে গেছে এখনো। তার দেখানো পথ ধরে দেশে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত এগিয়েছে বহুদূর। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঙ্গীতের এই ধারা পৌঁছে গেছে। তাই সঙ্গীত পিপাসুদের মনের একটা অংশে আয়েত আলী খাঁ’র নামটি খোদাই করা আছে স্বর্নাক্ষরে।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন