সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ , ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

স্বাধীনতার চেতনা

শ্যামা সরকার ২৫ মার্চ , ২০২৪, ১৫:৫৯:৪৭

447
  • স্বাধীনতার চেতনা

নরহত্যা মহাপাপ, তার চেয়ে পাপ আরো বড়ো 

করে যদি যারা তাঁর পুত্রসম বিশ্বাসভাজন 

জাতির জনক যিনি অতর্কিত তাঁরেই নিধন। 

নিধন সবংশে হলে সেই পাপ আরো গুরুতর 

সারাদেশ ভাগী হয় পিতৃঘাতী সে ঘোর পাপের 

যদি দেয় সাধুবাদ, যদি করে অপরাধ ক্ষমা। 

কর্মফল দিনে দিনে বর্ষে বর্ষে হয় এর জমা 

একদা বর্ষণ বজ্ররূপে সে অভিশাপের। 

অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণে’ কবিতার পঙক্তিমালা বাঙালি জাতির জন্য সত্যিকার অর্থে অভিশাপের। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে যে জঘন্য কাজ এ জাতি করেছে, তাদেরকে বিশ্ববাসী বিশ্বাস করে কিনা- বিষয়টি ভাবনার। একটি জাতির রূপকার, বাঙালির হৃদস্পন্দন- কেন, কিভাবে হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু? 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণে সুস্পষ্টভাবেই ফুটে ওঠে স্বাধীনতার ঘোষণা। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ 

এ ভাষণটি শুধু বঙ্গবন্ধুর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণ নয়, পৃথিবীর অন্যতম নেতাদের দেয়া ভাষণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। বিশ্ব ইতিহাসের সেরা ১০ ভাষণের মধ্যে অন্যতম ভাষণ হিসেবে এটি নির্বাচিত হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল ১৯৭১ সালে সংঘটিত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র সংগ্রাম, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পঁচিশে মার্চের কালরাতে পাকিস্তানিরা ঢাকায় সাধারণ নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও পুলিশ হত্যা করে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দল আওয়ামী লীগপ্রধান বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে।

১৯৪৭-এ ভারত বিভাগ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে শেখ মুজিব ছিলেন তরুণ ছাত্রনেতা। পরবর্তীতে তিনি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৪৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির মধ্য দিয়েই এ মহান নেতার রাজনৈতিক কর্মপরিচালনার সূচনা ঘটে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন গণপরিষদের অধিবেশনে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ এ ঘোষণার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে আন্দোলনের ডাক দেন তিনি। এখান থেকেই সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই পরিষদের আহ্বানে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট পালনকালে শেখ মুজিবসহ আরও কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মীকে সচিবালয় ভবনের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু ছাত্রসমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৫ মার্চ শেখ মুজিব এবং অন্য ছাত্রনেতাদের মুক্তি দেয়া হয়। 

এরপর থেকে বাঙালির ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচনসহ প্রত্যেকটি স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এ মহান নেতা ।  

১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইন সভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তানের কোটার ২টি আসন ছাড়া বাকি সবগুলোতে জয়ী হওয়ার জন্য জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জন করে আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে ইয়াহিয়া খান সংসদ অধিবেশন করতে দেরি করায় বাঙালিরা বুঝে ফেলে যে, মুজিবের দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠন করতে দেয়া হবে না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেন।

ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং মুজিবসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ও জনসাধারণের অসন্তোষ দমনে ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে। সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরু হলে মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ধানমণ্ডির ৩২নং বাড়ি থেকে অয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন । মূল ঘোষণা ছিল :

‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।’

মুজিবকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ফয়সালাবাদের একটি জেলে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত অভিযান অল্প সময়ের মধ্যেই হিংস্রতা ও তীব্র রক্তপাতে রূপ নেয়। রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও ইউনিয়ন নেতাসহ সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করে।

এ গণহত্যার মুখে সারাদেশে শুরু হয় প্রতিরোধযুদ্ধ। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্য এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ দেশকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে কয়েক মাসের মধ্যে গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। 

গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী সারাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সাহায্য লাভ করে। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে যখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পতন আনিবার্য হয়ে ওঠে, তখন পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পর্যুদস্ত ও হতোদ্যম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের দলিল এবং সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করার জন্য ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জেকব দুপুরে ঢাকা এসে পৌঁছান। বিকেল চারটার আগেই বাংলাদেশ বাহিনীর দুটি ইউনিটসহ চার ব্যাটালিয়ান সৈন্য ঢাকা প্রবেশ করে। সঙ্গে কয়েক সহস্র মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকার জনশূন্য পথঘাট ‘জয় বাংলা’ মুখরিত মানুষের ভিড়ে ক্রমশই জনাকীর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে। বিকেল চারটায় ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ও ভারত-বাংলাদেশ যুগ্ম-কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, পাকিস্তানের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন।

১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এরই মধ্য দিয়ে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয়; প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রাণের এ স্বাধীনতা। 

শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও ভারতীয় উপমহাদেশের একজন অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি বাঙালির অধিকার রক্ষায় ব্রিটিশ ভারত থেকে ভারত বিভাজন আন্দোলন এবং পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করেন। পরে মুজিব তাঁর অন্তর্বর্তী সংসদকে একটি নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেন এবং চারটি মূলনীতি হিসেবে ‘জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র’ ঘোষণা করেন যা মুজিববাদ নামেও পরিচিত। তিনি শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কোম্পানি রাষ্ট্রীয়করণসহ  প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করেন যা একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ।   

মাত্র সাড়ে ৩ বছরে দেশ পুনর্গঠনের কাজে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। দেশ যখন ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত ও সমৃদ্ধির পথে এগুচ্ছে ঠিক তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে কিছু বিপথগামী তরুণ সেনা কর্মকর্তা শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে। তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে প্রাণে বেঁচে যান।

মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা ও বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁরই স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার কাজে দৃপ্ত পদে এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনে বিশেষ সাফল্য দেখিয়েছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের পথে বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে নিজেকে অনুকরণীয় হিসেবে উপস্থাপন করতে সমর্থ হয়েছেন। এমডিজি ও এসডিজির বাইরেও দেশের একটি উন্নয়নের রূপরেখা রয়েছে যেটির রচয়িতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর স্বপ্ন ‘ভিশন-২০২১’-এর আওতায় দেশকে ২০২১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাস্তবায়ন করেছেন এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত করবেন। বিশ্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল যার নির্মাতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।

লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা- বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। এই অর্জনকে অর্থপূর্ণ করতে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে, ধারণ করতে হবে স্বাধীনতার চেতনা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দিতে হবে। এ প্রত্যাশা সবার কাছে। 

লেখক

অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ও প্রধান

কমিউনিকেশন, পাবলিকেশন অ্যান্ড রিসার্চ

উদ্দীপন।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন